অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী
অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী ''আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো ২১-এ ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলতে পারি!''
আমি ঠিক জানি কি না জানি না, ইংরেজিতে shanty কথাটার মানে, বস্তি। সেইটে ফলো করলে, shanty-র ছেলে মানে কিনা, বস্তির ছেলে। আর এদেশের বস্তির ছানাপোনাদের বিদেশে সব্বাই 'অস্কার-আদরে' ডাকে slumdog... আমি ভাবলাম, অলস বাঙালি জিভ হয়তো অপভ্রংশে 'শান্তি' বলে ফেলে..কিন্তু পরে এক পুরুষবন্ধুর কাছে আসল মানেটা জানার পর নিজেই জিভ কাটি!
এই 'অরিজিন্যাল' সৃজিত সাহসী কিন্তু নির্ভুল নন। তবে সৌমিক-অনুপম-বোধিসত্ত্ব এবং অভিনেতারা মিলিয়ে যে সঞ্জীবনী সঙ্ঘ, সেই টিম মেম্বাররাই বাঁচিয়ে তুলেছে হেমলক সোসাইটিকে। কাজেই বেনেফিট অফ ডাউটে সৃজিতের সাত খুন মাফ। হেমলক সোসাইটির ট্রেনিং আসলে জীবনের দিকে ইউ-টার্ন। ফিল্মসিটির অন্দরে ফুল গট আপ কেস। অভিনব উপায়ে বুঝিয়ে হাড়ে হাড়ে টের পাওয়ানো আত্মহত্যা কেন 'মহাপাপ'। পৃথিবীটাকে আরও গাঢ় সোনালি রঙের চশমায় নতুন করে দেখতে শেখানো.. মৃত্যু নয়, জীবন।
ভেবেছিলাম বোল্ড সিরিজের সেকেন্ড পার্ট লিখব। জীবনে টাইম বড় কম। বাইরে গরমের তাত বড় বেশি। তাই ঘর-বার হয়ে সিনেমা-মুখো হওয়ার প্ল্যান করেছেন যাঁরা, তাঁদের জন্য দুটি পেট-গরম-করা ছবি থেকে সাবধান হওয়ার টোটকা পরিবেশিত হল।
আমাদের বাঙালীজাতির সবথেকে গর্বের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এবার ২৫শে বৈশাখে তাঁর জন্মের সার্ধশতবর্ষ উদ্যাপিত হল। জোড়াসাঁকোর প্রভাতি অনুষ্ঠান থেকে সরকারী উদ্যোগে কবিপ্রণাম। পাশাপাশি অন্যান্য গণমাধ্যমগুলিতেও নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রবীন্দ্রস্মরণ।
আট-ন'বছর আগের কথা। কলকাতার নামী মিডিয়া হাউসের ট্রেনি জার্নালিস্ট আমি। প্রথম দিকের অ্যাসাইনমেন্ট। তখন মুম্বইয়ের এক মডেল-কাম-উঠতি অভিনেত্রী একটি বাংলা ছবির শুটিং করতে কলকাতায় এসেছেন। কলকাতার ক্যানভ্যাসে তখনও 'পাপারাত্জি'র পোঁচ পড়েনি, তাই খানিক নির্বিঘ্নে ইন্টারভিউ নেওয়া যেত। ঠাণ্ডা ঘরে বসেও কপালে অনভিজ্ঞতার ঘাম। নোটবুকে ঝালিয়ে নিচ্ছি শেষ মুহূর্তের প্রশ্নগুলো।
০১০ সাল থেকে বিশিষ্ট কয়েকজনের মুখ দিয়ে কলকাতা মুড়ে ফেলা হয়েছিল পরিবর্তনের স্লোগানে। এক বছর হয়ে গেল নতুন শাসন ব্যবস্থাও এসে গেছে এ রাজ্যে। কিন্তু স্কুলে, কলেজে, পার্ক স্ট্রিটে, বর্ধমানে, নোনাডাঙায়, পাহাড়ে, জঙ্গলে পাল্টালো কি ছবিটা? যার তৃণমূল নেই, সিপিআইএম নেই, কংগ্রেস নেই, বিজেপি নেই-সে কী করবে? তাকেও তো বলতে দিতে হবে, আমি ভয় পাই না কাউকে। না কি তাকে সারাজীবন শুনে যেতে হবে, 'আপনি কিছুই দেখেননি মাস্টারমশাই'!
আমার রবীন্দ্রনাথ আছেন, অতুলপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলাল আছেন, হিমাংশু দত্ত, মোহিনী চৌধুরী আছেন, আছে বাউল, ফকির, দরবেশি, গণগীত। আছেন ধনঞ্জয়, সতীনাথ, জটিলেশ্বর, পান্নালাল, সলিল চৌধুরী। আছেন গৌতম চট্টোপাধ্যায়...। তবু সুমন। এক প্রখর বাস্তব।
শুধু ইসলামের উপাসকদের প্রতি রাজ্য সরকারের এহেন কৃপা কেন? আরও যে ধর্মগুলি রয়েছে তাঁদের যাজকরা কী দোষ করলেন? খ্রিশ্চান পাদ্রীরা, শিখ গ্রন্থীরা, হিন্দু পুরোহিতরা, বৌদ্ধ ভিক্ষুরা কোন অপরাধে বঞ্চিত হবেন? সরকারি অনুগ্রহ পাওয়ার জন্য কি ধর্ম ও রাজনীতিকে যুক্ত করতে হবে? ধর্মীয় সমাবেশ থেকে রাজনীতির কথা বললে কি সরকারের হাত মুচড়ে টাকা আদায় করা যাবে? কী ভয়ঙ্কর সম্ভাবনার দরজা খুলে দেওয়া হল তা কি আদৌ বোঝার ক্ষমতা আছে ইমামদের সরকারি বৃত্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত যাঁরা নিলেন তাঁদের? নাকি জেনে বুঝেই আগুন নিয়ে খেলছেন তাঁরা? ধর্মকে রাজনীতির মাথায় চড়তে দেওয়ার প্রলয়ঙ্কর ফলাফল মাত্র দু দশক আগেই আমরা দেখেছি। অযোধ্যা কাণ্ড, বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং তার পরবর্তী ঘটনা তো আজকের রাজনীতিকদের ভুলে যাওয়ার কথা নয়। তার থেকেও যদি কেউ শিক্ষা না নেন তবে কোনও কিছু থেকেই তিনি আর শিক্ষা নেবেন বলে আশা করা বোধ হয় ঠিক হবে না।
রচনার শিরোনাম দেখে অনিবার্যভাবে মনে পড়ে যাবে সুকুমার রায়কে। মনে পড়ে যাবে গঙ্গারামকে। কিন্তু আমাদের ছেলেটি কোনওদিন ফেল করেনি। সে বরাবরই ফার্স্ট বয়। সে 'পাঁচ জনের একজন নয়, একেবারে পঞ্চম'। তার সময়ে সে-ই ক্রিকেট বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন। তার ব্যাটিং দেখলে আট বছরের বালকের চোখে রোদ্দুর খেলা করে। সে ক্লান্ত করনিকের সেরা বিনোদন, অশীতিপর বৃদ্ধের বাঁচার অক্সিজেন। আক্ষরিক অর্থেই গত দু'দশক ধরে ভারতীয় ক্রিকেটের অভিভাকের নাম সচিন তেন্ডুলকর। বিশ্ব ক্রিকেটের সবচেয়ে আলোচিত নামও সে।
না জানার মধ্যে এক ধরনের আদিম সরলতা আছে। না বোঝার মধ্যে আছে এক ধরনের আদিম আতঙ্ক। অনাদায়ী ঋণ আদায়ের জন্য সমবায় ব্যাঙ্কের দেওয়া সম্পত্তি বিক্রির নোটিসে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় অনেকেই এই সরল আতঙ্ক প্রত্যক্ষ করে থাকবেন। স্পষ্টতই মুখ্যমন্ত্রী মনে করেছিলেন (অন্তত সেই মুহূর্তে) 'দুই বিঘা জমি' কবিতাটির পুরাতন ভৃত্যের জমি কেড়ে নেওয়ার মতো ভয়ঙ্কর কোনও অন্যায় সংঘটিত হতে যাচ্ছে।
সে অনেক দিন আগেকার কথা। বছর কুড়ি হবে। তখন 'প্রাইমারি ইস্কুলে' পড়ি। আমাদের চারপাশে কিছু মানুষ থাকেন, যাঁদের প্রাথমিক ভাবে তুচ্ছ বলে মনে হয়। অনেক সময় অস্তিত্বের সাড়াও পাওয়া যায় না। সময় গড়ালে বোঝা যায়, কত গভীরে শিকড় গেড়েছে সে। বিশ্ব নারী দিবসের আগে তেমনই একজনের কথা মনে পড়ে গেল। একেবারে কাকতালীয় ভাবে।
সাদাপাতার সামনে একসময় নিয়ম করে বসতাম। কিছুই লিখতাম হয়ত। কিন্তু কথা হত। এখন যেমন হচ্ছে। নিভৃতের আলাপচারিতা। দু-এক ফোঁটা জল লেগে থাকত পাতার শরীরে। দেখতাম থেমে যাওয়া ঘড়ি দিনে দু-বার সঠিক সময় দিচ্ছে। ছায়া দীর্ঘায়িত হচ্ছে। আচমকা বিদ্যুত্ চমকের মত মাথায় আসত দু-একটি লাইন। প্রথমে একটি ঢেউ, তারপর নিরবিচ্ছিন্ন তরঙ্গের ঘাত প্রতিআঘাত। যেন চারিদিকে সবুজ গাছগাছালি ঝুঁকে থাকা শান্ত নিস্তরঙ্গ পুকুর। ফাঁকা দুপুরে কী এক বাতাস বইছে। ছোট্ট পাথর এখানে ওখানে ধাক্কা খেতে খেতে গড়িয়ে পড়ল জলে। সাদা পাতা জানত এসব কথা।
জিনিসটা কী? এক কোণে কাঠের বেঞ্চিতে বসার একটু পর সেই 'মাল' এল। আগুনের মতো গরম গোমাংসের খিচুড়ি। পাশে অল্প আচার। মোটা গোঁফ বলল `গোটা কলকাতায় আপাতত আমার ফেভারিট খাবার এটা। যত পারিস খা। কোনো শরীর খারাপের বালাই নেই। আমি তো এক-একদিন তিন চার প্লেট করে খাই।'
সৌন্দর্যায়নের ভাবনার সঙ্গে স্বেচ্ছাচারের মিশেল কতটা ভয়ঙ্কর অথবা কুত্সিত হতে পারে? সম্যক বুঝতে হলে এখন কলকাতায় আসতে হবে।
আসলে পাখি নয়, প্রজাপতি নয়, গাছপালা নয়- মনের গভীরে থাকা এক পলায়নী মনোবৃত্তির কারণেই নাকি অনেক মানুষ চারপাশের ভীষণ চেনা, কেজো, হিসেবি জগতের মধ্যেই অন্য একটা আপাত অচেনা, প্রায় অনুল্লেখ্য জগতের দিকে আকর্ষিত হয়। সময়ে-অসময়ে এই ঘরের ভিতরের ঘরটায় ঢুকে পড়া। এ-ও তো এক ধরনের ভ্রমণ? তবে সেই অপ্রয়োজনীয় ভ্রমণ কাহিনির লেখক কিংবা পাঠক সম্ভবত হতে পারেন দার্জিলিঙের পটভূমিকায় চলচ্চিত্রায়িত সত্যজিত্-ক্লাসিকের পাহাড়ী সান্যালের মতো আপাত গৌণ চরিত্ররাই।