দেশ

সাদাপাতার সামনে একসময় নিয়ম করে বসতাম। কিছুই লিখতাম হয়ত। কিন্তু কথা হত। এখন যেমন হচ্ছে। নিভৃতের আলাপচারিতা। দু-এক ফোঁটা জল লেগে থাকত পাতার শরীরে। দেখতাম থেমে যাওয়া ঘড়ি দিনে দু-বার সঠিক সময় দিচ্ছে। ছায়া দীর্ঘায়িত হচ্ছে। আচমকা বিদ্যুত্ চমকের মত মাথায় আসত দু-একটি লাইন। প্রথমে একটি ঢেউ, তারপর নিরবিচ্ছিন্ন তরঙ্গের ঘাত প্রতিআঘাত। যেন চারিদিকে সবুজ গাছগাছালি ঝুঁকে থাকা শান্ত নিস্তরঙ্গ পুকুর। ফাঁকা দুপুরে কী এক বাতাস বইছে। ছোট্ট পাথর এখানে ওখানে ধাক্কা খেতে খেতে গড়িয়ে পড়ল জলে। সাদা পাতা জানত এসব কথা।

Updated By: Mar 4, 2012, 06:35 PM IST

উড়ালপুলের পরেই উঁচু ক্রেন, যন্ত্রপাতি। দৈত্যাকার হুইলে জড়ানো অনন্ত কেবল্। শহরের অন্ধকার পেট চিরে ছুটে চলেছে। রাসবিহারির ট্রামলাইন থেকে মুছে যাচ্ছে ঘাসের অঘ্রাণ। মেঘ এইসময় ইউ টার্ন নিচ্ছে। দিকবদল করছে। মফস্বলের নিভু নিভু 'সিমপ্যাথি কর্নারে'র শাটার খোলার শব্দ হচ্ছে। বিক্রিবাট্টার বাজার একেবারেই ভালো যাচ্ছে না। দোকানের বাইরে হ্যাঙারে টাঙানো খুকুর পোশাক জল হাওয়া ধুলো খেয়ে মলিন হয়ে পড়েছে। উড়ালপুলের পরেই উঁচু ক্রেন, যন্ত্রপাতি। আকাশ চুম্বন করছে সারস। মাথায় হলুদ হেলমেট, গামবুট পরা শ্রমিকেরা মজুরির বিড়ি ধরিয়েছে সদলবলে। আট বছরের টগর শেষবেলার রোদে ভাত খাওয়া শেষ করছে। মালিকের থাপ্পড় সহ্য করছে। দেওয়ালে লেখা হচ্ছে: সামনেই নির্বাচন। সস্তা হচ্ছে উড়ানের খরচ। আর কৃষকের শ্যালো পাম্প চালানোর ডিজেলে ভর্তুকি তুলে দিচ্ছে সরকার। সিটি সেন্টারের অদূরেই রোল সেন্টার। মধ্যবর্তী অঞ্চলে চুইংগামের মত ঝুলে আছে দারিদ্ররেখার সীমানা। ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড ক্রমাগত থিয়োরি প্র্যাকটিস করছে। ১৩ জানুয়ারি, শুক্রবার, ওয়াশিংটন ডিসি। আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের সদর দফতর। Will Christine Lagarde stop the next global meltdown? দুপুরের বাসে অন্ধদের তৈরি ধূপকাঠি বিক্রি হচ্ছে না। প্রত্যেকেই টেক্সটিং-এ ব্যস্ত থাকছেন। খিদে সহ্য করতে না পেরে ৬ ছেলেমেয়েকে সঙ্গে নিয়ে চুপি চুপি বাড়ির দরজা এঁটে দিচ্ছেন ৩৬ বছরের রাজবালা। সন্তানদের মুখে ভাতের বদলে বিষ তুলে দিচ্ছেন। দেশনায়কের অতিকায় মূর্তির ছায়ায় কাটা পা নাচিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে পয়সা চাইছে ভিখিরিরা।

সাদাপাতার সামনে একসময় নিয়ম করে বসতাম। কিছুই লিখতাম না হয়ত। কিন্তু কথা হত। এখন যেমন হচ্ছে। নিভৃতের আলাপচারিতা। দু-এক ফোঁটা জল লেগে থাকত পাতার শরীরে। দেখতাম থেমে যাওয়া ঘড়ি দিনে দু-বার সঠিক সময় দিচ্ছে। ছায়া দীর্ঘায়িত হচ্ছে। আচমকা বিদ্যুত্‍ চমকের মত মাথায় আসত দু-একটি লাইন। প্রথমে একটি ঢেউ, তারপর নিরবিচ্ছিন্ন তরঙ্গের ঘাত প্রতিআঘাত। যেন চারিদিকে সবুজ গাছগাছালি ঝুঁকে থাকা শান্ত নিস্তরঙ্গ পুকুর। ফাঁকা দুপুরে কী এক বাতাস বইছে। ছোট্ট পাথর এখানে ওখানে ধাক্কা খেতে খেতে গড়িয়ে পড়ল জলে। সাদা পাতা জানত এসব কথা।

সহকর্মী কৌশিক সেন, শময়িতা চক্রবর্তীর সৌজন্যে ইদানিং ফের সেই সাদা পাতার মুখোমুখি বসতে হয়েছে। মনে পড়েছে আট বছরের টগরের কথা। সেনাবাহিনীর গুলি খেয়ে ঘাসের জঙ্গলে ঘুমিয়ে পড়া সত্তর বছরের বৃদ্ধ হাবিবুল্লা খানের কথা। আমার দেশের সন্তানদের কথা। যে সন্তান এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে বাবার ছিন্নভিন্ন মৃতদেহের সামনে।

২০০৫-এর গান্ধীজয়ন্তির দিন। খাঁ খাঁ বাতাস বইছে মানকেলি গ্রামে। মানকেলি ছত্তিসগড়ের ছোট্ট একটা গ্রাম। চারিদিকে অনুন্নয়ন আর দৈন্যের বলিরেখা। সেদিন গ্রাম থেকে গ্রামে গেল ওরা। ওরা মানে সালাওয়া জুড়ুম আর নাগা সেনারা। একত্রে বাড়িঘর, কুটির, বসতি ভেঙে গুঁড়িয়ে, সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিল। মাঠ থেকে টেনে নিয়ে গেল সন্তানের বাবাকে। বাবা চাষ করছিল সেসময়। প্রথমে সবাই মিলে মারল। উফ সেকি মার। বাবার নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছিল। হাতজোড় করে কাতর প্রার্থনা করছিল। ওরা শুনলো না। আরও মারল। আরও। তারপর কুঠার দিয়ে কোপালো। তারপর ছুরি দিয়ে ছিন্নভিন্ন করল। তারপর জ্যান্ত চোখ উপড়ে আনলো। তারপর একটা ধারালো ছুরি দিয়ে বুক চিরে ফুসফুস, নাড়িভুঁড়ি বের করলো। তারপর চামড়া ছাড়িয়ে ভেতর থেকে মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে ছড়িয়ে দিল এখানে ওখানে। শেষে একটা ভারী পাথর দিয়ে মাথার টমেটো ফাটিয়ে দিল। রক্ত, ঘিলু ছিটকে পড়ল ঘাসে। কালো কাক শূন্যে দু-পা তুলে নিথর। তার চোখ নেই। সেখানে অন্ধকার কোটর। দুই সন্তান আর তাদের মা পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল এই হত্যাদৃশ্য। বাবার কাটা আঙুল তখনও এদেশের কাদামাটি ধরে আছে। গান্ধীজয়ন্তির দিন মানকেলির আকাশে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলি পাক খাচ্ছে। আর্তনাদের খাঁ খাঁ বাতাস বইছে গ্রামে...

চলবে

সাম্যব্রত জোয়ারদার

Tags:
.