ভয় দূর হল কই?
০১০ সাল থেকে বিশিষ্ট কয়েকজনের মুখ দিয়ে কলকাতা মুড়ে ফেলা হয়েছিল পরিবর্তনের স্লোগানে। এক বছর হয়ে গেল নতুন শাসন ব্যবস্থাও এসে গেছে এ রাজ্যে। কিন্তু স্কুলে, কলেজে, পার্ক স্ট্রিটে, বর্ধমানে, নোনাডাঙায়, পাহাড়ে, জঙ্গলে পাল্টালো কি ছবিটা? যার তৃণমূল নেই, সিপিআইএম নেই, কংগ্রেস নেই, বিজেপি নেই-সে কী করবে? তাকেও তো বলতে দিতে হবে, আমি ভয় পাই না কাউকে। না কি তাকে সারাজীবন শুনে যেতে হবে, 'আপনি কিছুই দেখেননি মাস্টারমশাই'!
গল্পটা আমাকে বলেছিলেন জয় গোস্বামী। ১৯৪৭-৪৮ সালে অস্ট্রেলিয়া সফরে গিয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেট দল। সেই দলের উইকেটকিপার ছিলেন প্রবীর সেন, সবাই যাঁকে খোকন সেন বলেই বেশি জানেন। সেই প্রবীর সেনের লেখা উদ্ধৃত করেই গল্পটা বলেছিলেন। ব্র্যাডম্যানকে প্রথমবার বল করার সুযোগ পেয়ে খুবই উত্তেজিত ছিলেন ভারতের ফাস্ট বোলার দাত্তু ফাদকার। তো ব্র্যাডম্যান ব্যট করতে নেমেছেন। প্রথম বলটাই ফাদকার বাউন্সার করলেন। ব্র্যাডম্যান দেখে ছেড়ে দিলেন। দ্বিতীয় বলটাও তাই। ব্র্যাডম্যান এবারও দেখে ছেড়ে দিলেন। এভাবে দাত্তু ফাদকারের পরপর কয়েকটা বাউন্সার দেখেশুনে ছেড়ে দিলেন ব্র্যাডম্যান। তারপর আরও একটি বাউন্সার। এবার ব্র্যাডম্যান একটু লাফিয়ে আড়াআড়ি ভাবে সজোরে মারলেন। ফাদকার কোনওমতে মাথা নামালেন। বলটা তাঁর মাথার ওপর দিয়ে সোজা উড়ে গেল গ্যালারিতে। খোকন সেন জানাচ্ছেন, ওই সিরিজে ব্র্যাডম্যানকে আর একটিও বাউন্সার দেননি দাত্তু ফাদকার। গল্পটা বলে জয়দা বোঝাতে চেয়েছিলেন, শাসক সবসময় এইরকমই হয়। তোমার লাফালাফি কিছুদিন দেখবে, তারপর একদম নুইয়ে দেবে। ক্ষমতার ঔদ্ধত্য এটাই। ঠিকই। ক্ষমতার চোখরাঙানি ভয় পায় না কে?
এই শাসকের লক্ষ্যই মানবতাকে বন্দি করা। তাকে দমন করা। তাই খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে প্রমিথিউসকে মুক্ত করতে পারেননি ইসিলাস(অন্য মতে ইসকাইলাস)। সেখানে দেবতার কাছে হেরে যেতে হয় তাঁকে, গ্রিক ট্র্যাজিডির নিয়ম মেনেই। দেবতা, যিনি সর্বশক্তিমান। এই প্রমিথিউস কোনও এক জন নয়, সে মানবগোষ্ঠীর প্রতীক, মানবতার প্রতীক। তাই তাকে শেষপর্যন্ত মুক্ত করতে পারলেন পি বি শেলি, অনেক পরে, অষ্টাদশ শতাব্দীতে। ইংল্যান্ডে অলিভার ক্রমওয়েল ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন, যা 'ক্রমওয়েল রেভলিউশন' নামে পরিচিত। তাঁর নেতৃত্বেই সেখানে প্রথমবার রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা পায় ১৬৪৯ সালে। যদিও মাত্র ১১ বছর পরেই দ্বিতীয় চার্লস ফের রাজা হন। কবি মিলটন ছিলেন ক্রমওয়েলের সমর্থক। আর মিলটনই ইংল্যান্ডের প্রথম কবি যিনি রাজতন্ত্রবিরোধী হিসেবে পরিচিত।
রবীন্দ্রনাথও মানবতাকে বন্দির বিরোধী ছিলেন বরাবর। তাঁর শ্রেয় বোধ উপনিষদ থেকে আহৃত। তাই তিনিই লিখতে পারেন, 'আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে'। রবীন্দ্রনাথই রক্তকরবীতে মানবতার প্রতীক হিসেবে এনেছিলেন নন্দিনীকে। যেভাবে রামায়ণে রাবণ সীতাকে বন্দি করতে চেয়েছিলেন, রক্তকরবীর রাজাও সেভাবেই বন্দি করতে চেয়েছিলেন নন্দিনীকে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ মানবতার জয় দেখিয়েছিলেন। তাই রাজাকেও শেষ পর্যন্ত নন্দিনীর সঙ্গে বেরিয়ে আসতে হয়। মানবতা যখন আক্রান্ত হয়েছে, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে তার বিরুদ্ধে উঠে এসেছে প্রতিবাদ-কণ্ঠ। ক্ষমতার জোরে সেই কণ্ঠরোধের চেষ্টাও হয়েছে। আর তখন বিপন্ন হয়েছে মানবতা।
দাত্তু ফাদকারের গল্পটা শুনেছিলাম এ রাজ্যের বামশাসনের সময়। সেই শাসনে উত্পন্ন ভয় থেকেই সে গল্পের অবতারণা। ২০১০ সাল থেকে বিশিষ্ট কয়েকজনের মুখ দিয়ে কলকাতা মুড়ে ফেলা হয়েছিল পরিবর্তনের স্লোগানে। এক বছর হয়ে গেল নতুন শাসন ব্যবস্থাও এসে গেছে এ রাজ্যে। কিন্তু স্কুলে, কলেজে, পার্ক স্ট্রিটে, বর্ধমানে, নোনাডাঙায়, পাহাড়ে, জঙ্গলে পাল্টালো কি ছবিটা? যার তৃণমূল নেই, সিপিআইএম নেই, কংগ্রেস নেই, বিজেপি নেই-সে কী করবে? তাকেও তো বলতে দিতে হবে, আমি ভয় পাই না কাউকে। না কি তাকে সারাজীবন শুনে যেতে হবে, 'আপনি কিছুই দেখেননি মাস্টারমশাই'!