খাচ্ছি কিন্তু গিলছি না
ভেবেছিলাম বোল্ড সিরিজের সেকেন্ড পার্ট লিখব। জীবনে টাইম বড় কম। বাইরে গরমের তাত বড় বেশি। তাই ঘর-বার হয়ে সিনেমা-মুখো হওয়ার প্ল্যান করেছেন যাঁরা, তাঁদের জন্য দুটি পেট-গরম-করা ছবি থেকে সাবধান হওয়ার টোটকা পরিবেশিত হল।
ভেবেছিলাম বোল্ড সিরিজের সেকেন্ড পার্ট লিখব। জীবনে টাইম বড় কম। বাইরে গরমের তাত বড় বেশি। তাই ঘর-বার হয়ে সিনেমা-মুখো হওয়ার প্ল্যান করেছেন যাঁরা, তাঁদের জন্য দুটি পেট-গরম-করা ছবি থেকে সাবধান হওয়ার টোটকা পরিবেশিত হল।
যে ছবি কয়েক মিনিট বসে দেখা যায় না
----------------------
রাতদিন সাতদিন শরীর শরীর করে মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল ভদ্রলোকের! কী ছবি বানিয়েছেন...মা মেরির দিব্যি...শুরুতেই ফিউজ উড়ে গেল ডিম আগে না মুরগি আগে...সরি, 'ডাঁসা' আগে না 'ডবকা' আগে ভাবতে গিয়ে। (এমন দড়কচা ডায়লগ, যেন বিনি-খরচে কোনও ইনটার্নকে চিত্রনাট্যে হাত-পাকানোর ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে) তার পর কী এডিটিং! বিয়েবাড়ির শুটিং ভিডিয়ো যেমনভাবে কাটা হয়- ঠিক ঘুড়ির মতো শোঁ-ও-ও করে উড়ে গেল ফ্রেম। তিন মিনিট দেখেই হলময় হাই উঠছে। আরে বাপু, কখন কয়েকটি মামণিকে দেখাবেন বলুন তো? কিছু ঠাহর করার আগেই হঠাত্ ক্যাকটাসের এক গায়ক ক্যাঁক করে গেয়ে উঠলেন ... খুঁটেঃ খাঃ জীবনেরইইঃ দানাঃ.. হা হা হা---। সঙ্গে মামণিদের কী বিচিত্র মুখ-মচকানি! এ কি ইন্ট্রো রে বাপ! এটা কি হরর মুভি? অমন করছেন কেন মালক্ষ্মীরা! যা হোক, এরকম একটা পিলে-চমকানো কার্যকারণহীন মিউজিক ভিডিয়োর হেঁচকির পর ছবি স্টার্ট নিল।
ওঃ হো, পরে ভুলে যাব, ছোট্ট করে বলে নিই, এ ছবির সাবজেক্ট হল না-খায়-না-মাথায়-দেয় এসকর্ট সার্ভিস। ভদ্রলোকের দাবি, তিনি ছবি বানানোর আগে গুছিয়ে 'হোমওয়র্ক' করেছিলেন 'এসকর্ট'-দের নিয়ে...মাপ করবেন, এসকর্ট সার্ভিস নিয়ে। আরও দাবি তাঁর, বাংলা ছবির ইতিহাসে নাকি এমন সাবজেক্ট তিনি 'নতুন'বার করে দেখাবেন!
আমরা হলাম গিয়ে, ইয়ে, হাঁ-করা দর্শক। ইতিহাস-টিতিহাস ঘেঁটে আসি না। পোস্টার দেখে একটু ' ইয়ে' মনে হলে, স্ট্রেট টিকিট কেটে হলে ঢুকি। হাঁ করে গিলি। খানিক বেশি ইয়ে মনে হলে ফিল্ম রিভিউটায় একটু চোখ বুলোই। খবরকাগজের সাপ্লিমেন্টের পাবলিসিটি লেখাগুলোয় একটু ত্যারচা চোখ বুলিয়ে নিই। পয়সা না গচ্ছা যায়!
পোস্টারে দেখলুম ললনাদের লোলুপ ইশারা। তাদের ইয়ে-ইয়ে ড্রেস। কাগজে দেখলুম ফাইভস্টারে সুন্দরীদের ফোটোশুট আর 'চ্যাট'। মিছে নয়, কিছু আছে। তবু কী শিওর হওয়া যায়...! ট্যারাব্যাঁকা আলোয় টালমাটাল মামণিরা ডিস্কে নাচলেন কী? না, 'দুধের সাথে চিনি দিয়ে জমিয়ে দেব সর'!!! কলকাতার কোন ডিস্কে এমন লিরিক্স চলে, স্যর?? চার-ছখানি জুনিয়র আর্টিস্টকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে, শুধু নাচুনে মামণিদের শরীর বেয়ে নাগরদোলার মতো ওপর-নিচ করে ফাঁকিবাজির একশেষ করেছে ক্যামেরাম্যান... মরুক গে, কাজের কথায় আসি। গ্যাস জ্বালিয়ে দেখেছি, দুধে চিনি না মেশালেও সর পড়ে। এ ভদ্রলোক যে চিনির বদলে দুধে চোনা মিশিয়ে পচা ছানা কেটে ফেলেছেন। এমন দুর্গন্ধ যে মনুষ্যখাদ্য হিসেবে প্যাকেজ করতে চোখের-জলে নাকের-জলে হয়েছেন প্রোডিউসর!
আরও আছে। প্রোমোয় এক মামণিকে দেখলাম হকারি ঠাটে বলছেন, 'এসকর্ট সার্ভিস লাগবে দাদা, এসকর্ট সার্ভিস?'... মনে হল কী না কী হরির লুঠ দেখব! ছররা দিয়ে মোম-চিকনাই সুন্দরীরা বেরুবেন। পিঁ-পিঁ করে ইংলিশ বলবেন। রাজামশাই চাইলেই বালিকা পাইবেন! নৈশকলকাতায় জিয়ন্ত মুলাঁ রুজ। আহা! না-জানি সে কী বিশ্বদর্শন হবে... এমনই লাক খারাপ, মুলাঁ রুজ কি, মুলোটাও জুটল না কপালে। হাঁ আপনি বুজে এল। 'মাগী' উচ্চারণ করতেই মামণিদের যা জিভের কষ্ট, দেখে চোখে জল আসে। শোনায় বাচ্চাবেলার টিফিন টু-মিনিট নুডলের মতো। এক মামণিকে দেখি, কে-এক কানামানুষের সঙ্গে রাস্তা পার হয়ে চলে গেলেন তাঁর ঘরে। ট্যাঁ-ট্যা করে তোতাপাখির মতো আউড়ে গেলেন, 'আমি সাধারণ মেয়ে' (রবীন্দ্রনাথে ভক্তি আছে)। যেদিন আলাপ, সেদিনই ইয়ে, সেদিনই প্রেম। এক মামণি মনিটর-গোছের, সবার ওপর রেঁলা নেন। কিন্তু ডিস্কে গিয়ে সদ্য-কলেজ-পাশ-মিলিয়োনেয়ার-বাপের-বেটা ভেবে আধদামড়া টেকোকে তুলে পই-পই করে 'পজিশন' বোঝাতে যান কেন, কে জানে! এক মামণির আবার এক স্টেপ পজিশন হাই। মাফিয়ার বউ। দাঁত মাজতে মাজতে ব্ল্যাকবেরিতে কথা বলেন। সোনালি উইগ পরে মেয়ে-মেয়ে খেলেন। কিন্তু অ-সা-ধা-র-ণ (সত্যি অসাধারণ। ইয়ে করছি না!) এরোবিক্স নাচেন। কিন্তু নাচলে কী হবে? লুটনেওয়ালা ক্যামেরা তার শরীর বেয়ে এমনই হড়কেছে, নায়িকার সব পরিশ্রম মাঠে মারা গেছে। আরেক মামণি, কপালগেরোয় শিলিগুড়ি থেকে গুড়িগুড়ি এসে ভিড়ে গিয়েছেন। পড়েছেন মাফিয়ার বউয়ের খপ্পরে। এদের মধ্যে বিন্তিপিসি যিনি, তিনি আবার থাকেন এক হিজড়ের সঙ্গে। এক ছোটমামণি আবার পলিপ্যাকে ডেনড্রাইট শোঁকেন। আদুড় গায়ে এক ভূতুড়ে এসকর্টের সঙ্গে উদোম প্রেম করে, তার সঙ্গেই পালায়, তাকেই আবার হারিয়ে খোঁজে...বুজরুকির একশেষ! মোটের ওপর, কে যে কার সঙ্গে প্রেম করছে, কার সঙ্গে ভেগে পড়ছে। সমকামী-বিষমকামী-উভকামী সব মিলিয়ে এমন এক পেট-খারাপ-করা চচ্চড়ি, এমন স্ট্রেসফুল জেন্ডার ঝঞ্ঝাবাত, আমি বাপু বাপের জন্মে দেখিনি। ভদ্রলোক খানিক পেদ্রো আলমাডোভার, খানিক বুনুয়েল, খানিক আন্তোনিওনি, খানিক অ্যাঞ্জেলোপলস ঘুরে ঘুরে, বেলতলা-আমড়াতলা পেরিয়ে সেই বটতলার ছায়াতে বসে সিনেমা-টিনেমা বানিয়েছেন...
সত্যি, বড় এলাটিং-বেলাটিং 'বই' লো! আর বেশি না লিখে, ভদ্রলোককে একখান শলা দিই। অত চাপ না নিয়ে, বরং আপনি প্রথমে একটি মেয়েকে নিয়ে ছবি বানান। তারপর দুটি। তারপর তিনটি। স্টেপ বাই স্টেপ। এক চান্সে কয়েকটি মেয়েকে নিয়ে গল্প বলতে গিয়ে আপনি এমন ঘেঁটে-গুলিয়ে ফেললেন, মা মেরির দিব্যি... মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে গেল!
যে ছবি এক মিনিট বসে দেখা যায় না
---------------------
মা গো, ও মা! শুক্কুরবার এলেই আমার কেমন হাঁটু বেঁকে যায় বিশ্বাস করুন। এ কি ছবি, না স্-স্-সবি! মা-বোনেরা অভিমান না করে একটু ধৈর্য ধরে পড়ে নিন। আড়াই ঘণ্টা সময় বাঁচবে। গ্যারান্টি।
যাঁরা অমিতাভ-জয়ার সেই প্রাণজুড়নো ছবির রিমেক আশা করছেন, তাঁরা চোখ বুজুন। এক কথায়, এ ছবি দেখে আমরা জানতে পারলাম, মেয়েদের পিরিয়ড হয়। সদ্য-বিবাহিতা নিউজ-অ্যাঙ্কর নায়িকা শহর জুড়ে বিষম রায়টের দিনে এক দাগী ছিনতাইবাজের সঙ্গে রাত কাটান। সেই রাতেই তাঁর পিরিয়ড হয়...এবং, কী ভয়ানক! তাঁর ব্যাগে সেই অপরিহার্য বস্তুটি নেই। (অত বড় একটা ভ্যানিটি ব্যাগে ওই নিরীহ জিনিসটির স্থান সংকুলান হয় না, অথবা নেহাতই মিসটেক বলে মাপ করে দেওয়া যেতে পারে) যাই হোক, অগত্যা ছিনতাইবাজের কাছেই সেই অমোঘ কাকুতি। এক মাথা দুর্যোগ নিয়ে ছিনতাইবাজ ঘরবার হলেন। অন্ধকার কারফিউ। খালি হাতে ব্যাক। কী হবে!
স্ক্রিনটাইমে রাতভোর। (দর্শকের সিটে মহিলাদের সমস্বর ভয়-লজ্জা-অনুকম্পা মিশ্রিত চাপা বিষ্ময়- 'ওই--ওই- দ্যাখ, ইশশশশ!') সারারাত স্যানিটারি-ন্যাপকিনহীনতায় নায়িকার শাড়ীতে রজঃচিহ্ন স্পষ্ট! (টেকনিক্যালি, শাড়ির পেছনে এক পোঁচ আলতার দাগ..আচ্ছা, সারা রাতে পর বুঝি এতটুকু 'বিপদ' হয়?) আরও আছে। নায়িকাকে ছিনতাইবাজ একখান শার্ট উপহার দেয়। বলে, আপনার এটা দরকার। নায়িকা বেকার ডায়লগবাজি না করে চুপচাপ শাড়ির আঁচল গোঁজে। কোমরে কষে বেঁধে নেয় শার্ট। কাট টু। দুর্যোগরাত কাটিয়ে শ্বশুরবাড়ি ফিরতেই সবার ইঙ্গিতে ত্যাজ্য হন নায়িকা। কোমরের শার্ট খুলে ফেরত দেন ছিনতাইবাজকে। কী ভেলকি! শাড়ির দাগ তখনও দৈর্ঘে-প্রস্থে অটুট! একবুক কান্না নিয়ে নায়িকা ঘরে ঢোকে। চেয়ারে বসে। টেবিলে কপাল রেখে ভাবনায় ডোবে। শ্বশুরবাড়ির পরিজনদের ডাকতে যায়। (প্রায় দুঘন্টার স্ক্রিনটাইমে নায়িকার কোনও উদ্যোগই নেই পরিপাটি হয়ে নেওয়ার!) কিমাশ্চর্যম্! কম-সে-কম দশ ঘণ্টার টাইম ল্যাপস...তবু শাড়ির দাগের কন্টিনিউয়িটি বেশ মেনটেন করেছেন ডিরেক্টর ও তাঁর টিম অফ এডি!!!
মা-বোনেরা, ভ্রু কুঁচকে ভাবছেন কী সব লিখছি? রিভিউয়ের গ্রামার ভেঙে এসব কী বিতিকুচ্ছিত ভাষা! আচ্ছা, যে-ছবির প্রোমোতেই নায়িকা বলছেন যে তাঁর স্যানিটারি ন্যাপকিন লাগবে...আর আমি তা নিয়ে কিছু বললেই দোষ? এ কেমন ব্যাভার? ছবির গোটা গল্পে ওই গোটা নাটকটা এক্কেবারে দরকার ছিল না। শুধুই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এমন সংবেদনশীল বিষয়ের এই অবান্তর উপস্থাপনা বন্ধ হোক। ছবিটির প্রোডিউসর এক নয়া ফিল্ম ইনস্টিটিউট। ডিরেক্টর ভদ্রলোক যেন অবিলম্বে লম্বা কোনও কোর্স করে নিতে পারেন, সেটা একেবারে সেন্টপারসেন্ট অ্যাশিওর করা হয়। শাড়ি উড়িয়ে নায়িকা ছ্যারছ্যারে বৃষ্টিতে ভেজার দিন যে এক্কেবারে খতম, এটা বোধহয় ডিরেক্টর মোট্টে জানেন না!
বুদ্ধি আর কালি, কোনওটাই যাতে বেশি খরচা না হয়, তাই শর্টে সারলাম। শেষ পাতে ভুলু-ভুলু নিউজ অ্যাঙ্কর বান্ধবীদের একটা স্ট্যাচুটরি ওয়ার্নিং...যাঃ, অ্যাই একটা পেন দে তো, লেখাটা শেষ করি।
ফুলকলি