মৃণাল তর্পণে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, বিমান বসু ও সীতারাম ইয়েচুরি
রবিবার তাঁর জীবনাবসানে শোকপ্রকাশ করেছেন পলিট ব্যুরো সদস্য বিমান বসু, বাম নেতা তথা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।
নিজস্ব প্রতিবেদন: বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্র-ব্যক্তিত্ব মৃণাল সেন আর নেই। চলচ্চিত্র দুনিয়ার মানুষ পরিচালক মৃণাল সেন আজীবন বামপন্থায় বিশ্বাসী ছিলেন। ছাত্রজীবন থেকেই কমিউনিস্ট ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন তিনি। যদিও তিনি কোনওদিনই কোনও রাজনৈতিক দলে যোগ দেননি। তবে বামফ্রন্ট মনোনীত রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন তিনি। রবিবার তাঁর জীবনাবসানে শোকপ্রকাশ করেছেন পলিট ব্যুরো সদস্য বিমান বসু, বাম নেতা তথা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।
মৃণাল সেনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রবিবার বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান ও সি পি আই (এম) পলিট ব্যুরো সদস্য বিমান বসু বলেন, ''মৃণাল সেন একজন কিংবদন্তী ভারতীয় তথা আন্তর্জাতিক ‘ফিল্ম মেকার’ বলেই পরিচিত। তাঁর বিপুলায়তন সৃষ্টি না হলেও ত্রিশটির মতো পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছায়াছবিতে উঠে এসেছে পরিচিত সমাজ ও সময়। এর ওপরেই তাঁর সৃষ্টিগুলি কালজয়ী হয়ে উঠেছে। তিনি ছিলেন একজন সমাজবন্ধু, মানবিক এবং মার্কসবাদী ব্যক্তিত্ব। যদিও তিনি কোনো বামপন্থী রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলেন না। তবে, মৃণাল সেন কেন্দ্রে সংযুক্ত মোর্চা (ইউনাইটেড ফ্রন্ট)-র সরকার থাকাকালীন বামপন্থীদের উদ্যোগে রাজ্যসভার মনোনীত সাংসদ হন। ১৯৯৭ সালের ২৭শে আগস্ট থেকে ২০০৩ সালের ২৬শে আগস্ট পর্যন্ত তিনি সাংসদ ছিলেন। যেখানে যখন সাধারণ মানুষ অত্যাচারিত হয়েছেন তখনই সমাজসচেতন স্রষ্টা এই মানুষটির মন কেঁদেছে। তিনি বিচলিত হয়েছেন। সেই অস্থিতিকর পরিস্থিতির দিনলিপি বর্ণিত হয়েছে তাঁর কাহিনীমূলক বহু চলচ্চিত্রে। মৃণালদা ছিলেন এই দেশ ও বিশ্বের ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে মানবিক, সমাজসচেতন এক ব্যক্তিত্ব। দেশবিদেশে তাঁর খ্যাতি ছিল সর্বজনবিদিত। তাঁর শুরুর দিকের ছবি ‘ভোরের আকাশ’, ‘নীল আকাশের নীচে’ দেখেছি একাধিকবার। ‘ভূবন সোম’-ও দেখেছি। তারপরেও তাঁর অনেক ছবি দেখেছি। তবে তিনি এখনকার চলচ্চিত্র পরিচালকদের অনেকের মত অসংখ্য সৃষ্টি করেননি। সমকালীন সময় নিয়ে সাধারণের জীবনের ওপর দরদ দিয়ে ছবি তৈরি করতেন। বলতে গেলে সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক আর মৃণাল সেন ছিলেন সৃষ্টির মহিমায় একই বন্ধনীর মধ্যে থাকা চলচ্চিত্রকার। ছাত্রজীবনের মাঝামাঝি সময় থেকে তাঁর বামপন্থী মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায় নানান সামাজিক কাজে। চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গিয়েও তাঁর সৃষ্টিতে বামপন্থী চিন্তাচেতনার প্রতিফলন এসেছে বারবার। তিনি ছিলেন গণনাট্য সংঘের প্রথম সারির একজন। এখনকার বাংলাদেশের ফরিদপুরে তাঁর জন্ম হলেও মৃণালদা ছিলেন আদ্যন্ত কলকাতার মানুষ। গত শতাব্দীর সত্তর দশকের অশান্ত ও উথাল-পাথাল সময়ে তিনি তৈরি করেছিলেন ‘কলকাতা ৭১’ ছায়াছবি, যা সর্বত্র প্রশংসিত হয়েছে। দেশবিদেশে একাধিক সম্মানে তিনি ভূষিত হয়েছেন। মস্কো ও বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে একাধিকবার জুরি বোর্ডের সদস্য হয়েছিলেন। ‘প্যারালাল সিনেমা’-র ক্ষেত্রে মৃণালদা ছিলেন একজন অনন্য ভারতীয় চলচ্চিত্রকার। তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল খুবই ঘনিষ্ট। তিনি ছিলেন একজন বামপন্থী সৎ ও সাহসী মানুষ। এটা এদেশের সকল বামপন্থী মানুষের গর্ব।''
আরও পড়ুন-'মৃণালদার জন্য কাঁদতেও খারাপ লাগে', বলেও চোখের জল বাদ মানলো না মমতা শঙ্করের
বন্ধু তথা পরিচালর মৃণাল সেনের প্রয়াণ শোকবার্তা পাঠিয়েছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও। তিনি লিখেছেন, '' আজ সকালে মৃণালদার মারা যাওয়ার খবর পেলাম। এ আমার নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুসংবাদ। সত্যিকারের একটি যুগের অবসান হলো, তিনি যার শেষ প্রতিনিধি ছিলেন। চার দশক ধরে তিনি অনেকগুলি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। বেশিরভাগই উত্তীর্ণ, সাফল্যের মুকুটও এনেছে দেশ-বিদেশ থেকে। চলচ্চিত্রে নির্মম বাস্তবতার সঙ্গে সৌন্দর্যময়তার যোগ, এই নিয়ে মৃণাল সেনের চলচ্চিত্রের নিজস্ব ভাষা তৈরি হয়েছিল। এখানেই তাঁর স্বাতন্ত্র্য। সত্তরের দশকের শুরুতে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে তিনি বুঝতে সাহায্য করেছেন দেশ-বিদেশের মানুষকে। মৃণাল সেন ছিলেন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব। রাশিয়া, জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স এমনকি সুদূর চিলির পরিচালকদের সঙ্গেও ছিলো তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব। ভাবনাচিন্তায় তিনি ছিলেন দেশীয়, কিন্তু আন্তর্জাতিকতাবাদী, মুক্ত মনের মানুষ। চলচ্চিত্র পরিচালক মৃণাল সেন অবশ্যই বামপন্থী ছিলেন। বিশ্বাসে, জীবনযাপনে শেষদিন পর্যন্ত তিনি বামপন্থী ছিলেন। বহুবার তাই কলকাতার রাস্তায় তাঁকে পেয়েছি পায়ে পায়ে মানুষের মিছিলে। চলচ্চিত্রকার হিসাবে তাঁর জীবনবীক্ষার শিকড়ে ছিল বামপন্থা।মৃণালদা নব্বই বছর অতিক্রম করেছেন। মৃত্যুর আগে শরীরে কোনো অসুখ তাঁকে কষ্ট দেয়নি। তাঁর জন্মদিনে অনেক কথাবার্তাও হয়েছে আমার সঙ্গে। শারীরিক অসুস্থতা না থাকলেও দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশের জন্য একটা অশান্তি অস্বস্তি তাঁর মনে ছিলো। সেই নিয়েই তিনি চলে গেলেন। তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জানাই।''
আরও পড়ুন-মৃণাল সেনের মৃত্যুতে শোকবার্তা প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির
আরও পড়ুন-পারিবারিক আয়োজনেই হবে মৃণাল সেনের শেষকৃত্য, দেহ রাখা হল পিস ওয়ার্ল্ডে
পরিচালক মৃণাল সেনের মৃত্যতে টুইট করে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেছেন পলিট ব্যুরো সদস্য সীতারাম ইয়েচুরি।
Mrinal Sen’s passing away is a big loss not only to Cinema but to the world of Culture & India's civilisational values. Mrinal da radicalised Cinematography by his people-centric humanistic narrative. Deepest condolences. https://t.co/SXkwr5NQKf
— Sitaram Yechury (@SitaramYechury) December 30, 2018
প্রয়াত পরিচালকের পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, দীর্ঘদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন তিনি। রবিবার সকালে হৃদরোগে আক্রান্ত হন। সাড়ে ১০টা নাগাদ ভবানীপুরের বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বর্ষীয়ান পরিচালক। ১৯২৩ সালে ১৪ মে বর্তমান বাংলাদেশের ফরিদপুরে জন্মগ্রহণ করেন মৃণাল সেন। পড়াশোনার জন্য কলকাতায় আসেন। স্কটিশ চার্চ কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন তিনি।
'রাতভোর' (১৯৫৫) ছবি দিয়ে সিনেমা বানানোয় হাতেখড়ি হয় মৃণাল সেনের। যদিও সেই ছবিটি তেমন সাফল্যের মুখ দেখেনি। দ্বিতীয় ছবি 'নীল আকাশের নীচে' তাঁকে পরিচিতি দেয়। তৃতীয় ছবি 'বাইশে শ্রাবণ' তাঁকে আন্তর্জাতিক স্তরে প্রতিষ্ঠা দেয়। তাঁর পরিচালনায় বাংলার দর্শক উপহার পেয়েছে অসামান্য কিছু ছবি। মৃণাল সেনের সৃষ্টির ঝুলিতে রয়েছে 'ভুবনসোম', 'কোরাস', 'মৃগয়া', 'আকালের সন্ধানে', 'পুনঃশ্চ', 'পরশুরাম', 'একদিন প্রতিদিনে'র মতো অসামান্য সব ছবি। তাঁর শেষ ছবি 'আমার ভুবন' (২০০২)। সর্বমোট ২৭টি পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবি, ১৪টি স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি ও ৪টি তথ্যচিত্রের পরিচালনা করেছিলেন মৃণাল সেন।
কিংবদন্তী পরিচালকের ঝুলিতে রয়েছে ১৮টি জাতীয়, ১২টি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র পুরস্কার। মস্কো, বার্লিন, কান ফেস্টিভ্যালে পুরস্কৃত হন তিনি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে বহু সম্মানে ভূষিত হয়েছেন মৃণাল সেন। ১৯৮১ সালে তাঁকে পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত করে ভারত সরকার। ২০০৫ সালে ভারত সরকার প্রদত্ত বিনোদন জগতের সর্বোচ্চ সম্মান দাদাসাহেব ফালকে অ্যাওয়ার্ড পান তিনি। সাহিত্য ও শিল্পে অনস্বীকার্য অবদানের জন্য তাঁকে কম্যান্ডার অফ দ্য অর্ডার অফ আর্টস অ্যান্ড লেটারস (Ordre des Arts et des Lettres ) সম্মানে সম্মানিত করেছিল ফরাসি সরকার। ফ্রান্সের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান কম্যান্ডার অফ দ্য অর্ডার অফ আর্টস অ্যান্ড লেটারস। মহীরূহের প্রয়াণে শোকের ছায়া নেমে এসেছে বিনোদন জগতে।
আরও পড়ুন-পুনশ্চ মৃণাল, স্মরণ করলেন সৌমিত্র, মাধবী, অপর্ণা সেন ও অনিরুদ্ধ ধর