যেন বহু মৃত্যুর একখানি বিবর্ণ মালা হয়েই রয়ে গেল এই ২০২০
তবু বাঙালি ফিরে তাকাবে শোকের দিকে আবারও নতুন করে এগিয়ে চলার জন্যই
সৌমিত্র সেন
পাতা ঝরে যায়। জেগে ওঠে নতুন পল্লব। ছাতার মতো কোনও বড় পাতার নীচে ভোরের দোয়েলপাখির মতোই চুপ করে বসে থাকে আমাদের আনন্দ-দুঃখ-কান্না-সুখমাখা নিবিড় নিভৃত জীবন।
বছরের পর বছর বয়ে যায়। চলে যায়। কাল নিরবধি। তবুও বছর শেষ হয়, বছর শুরু হয়; এবং আমরা তা মনে করি, মনে রাখি, উদযাপন করি। ফিরে তাকাই মাঠঘাট গলিরাস্তা পেরিয়ে হারিয়ে মিলিয়ে যাওয়া বিদায়ী বছরটির দিকে।
অন্তত এই ২০২০ সালের দিকে তাকালে সব চেয়ে আগে মনে পড়ে, মনে না-পড়ে যায় না, করোনাভাইরাসের জেরে ঘটা অতিমারীর কথা। করোনারূপী দৈত্য এই বছরটিকে নিয়ে যেন বিরাটশিশুর মতোই ছেলেখেলা করল।
গোটা বিশ্ব এর আগে যা যা দেখেছে, যে-যে ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, তার কোনও কিছুর সঙ্গেই করোনা-অতিমারীকে মেলানো যায়নি। ঘোরতর বেমানান এক বিপদ ছারখার করে দিয়েছে পৃথিবীটিকে। কখনও মনে হয়েছে, এর জেরে এই লেগে গেল বুঝি যুদ্ধ! কখনও মনে হয়েছে, এর জেরে ঘটা মৃত্যুমিছিলের বুঝি আর শেষ নেই! এই বোধ হয় মানবসভ্য়তার মৃত্যুঘণ্টা বেজে গেল!
না, মানুষ হাল ছেড়ে দেয় না বলেই, সে মানুষ। সে এই মহাবিপদের চোখে চোখ রেখে লড়ে যায়। সেই লড়াইয়ের জেরে এসেও গিয়েছে করোনাটিকা। কোনও কোনও দেশে শুরু হয়ে গিয়েছে টিকাকরণের কাজ। ভারতেও অচিরেই আসতে চলেছে এই টিকা।
কিন্তু যত যা-ই হোক না কেন, করোনা-স্মৃতি যাওয়ার নয়। স্মৃতি এক্ষেত্রে সততই সুখের নয়। বরং স্মৃতি তুমি বেদনার।
হয়তো এমন দিনও আসবে, বহু বছর পরে কোনও এক বয়স্ক মানুষকে নিয়ে হইহই শুরু হয়ে যাবে কোনও দেশের কোনও সমাজে। শুধু এই জন্য যে, তিনি করোনা-অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন! তাঁকে ঘিরে হয়তো বসে যাবে সেকালের তরুণ প্রজন্ম, শুনবে, ঠিক কী হয়েছিল সেই সময়ে পৃথিবীতে।
হতভাগ্য বাঙালির কপাল অবশ্য শুধু করোনা পোড়ায়নি। অনেকগুলি মৃত্যু এসে বিধ্বস্ত করে দিয়ে গিয়েছে বাঙালিকে। এই ২০২০ যেন বাঙালির কাছে নানা মৃত্যুর একখানি মালা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই ২০২০-তে, করোনাকবলিত এই দুঃসহ দুর্বহ বছরে বাঙালি হারিয়েছে নৃত্যশিল্পী অমলাশঙ্করকে, অভিনেতা তাপস পাল, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সন্তু মুখার্জী, মনু মুখার্জীকে, ক্রীড়াজগতের দুই নক্ষত্র চুণী গোস্বামী ও পিকে'কে, সঙ্গীতশিল্পী পূর্বা দামকে, সঙ্গীততাত্ত্বিক সুধীর চক্রবর্তীকে এবং কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তকে। রাজনীতির ক্ষেত্রেও আমরা হারিয়েছি সোমেন মিত্র ও শ্যামল চক্রবর্তীকে। মুম্বই-নির্ভর বাঙালি চিত্রপরিচালক বাসু চট্টোপাধ্যায়কেও আমরা হারিয়েছি এই পর্বেই।
তবে, এর মধ্যে সংস্কৃতিপ্রেমী বাঙালিকে সম্ভবত সব চেয়ে বেশি ধাক্কা দিয়েছে সৌমিত্র ও অলোকরঞ্জনের মৃত্যু।
'অপু'র চোখের স্বপ্নভরা বেদনার সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিল বাঙালি। রেলট্র্যাক ধরে বন্ধুর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে এক সদ্য তরুণ ছড়িয়ে দিচ্ছেন তাঁর স্বপ্নসুষমা। কিন্তু তবুও সৌমিত্র তো শুধু অভিনেতা নন। তিনি ছিলেন বাঙালির অন্যতম সাংস্কৃতিক আইকন। রুপোলি পর্দা ছাড়াও আরও নানা ক্ষেত্রে তিনি তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গিয়েছেন। তাঁর মৃত্যুতে হঠাৎই বড় বিবর্ণ হয়ে পড়ল বাঙালির একান্ত নিজস্ব সাংস্কৃতিক জগৎ।
আর অলোকরঞ্জন? আক্ষরিক অর্থেই তিনি বোধ হয় বাংলাভাষার শেষ আন্তর্জাতিক কবি ছিলেন। শুধু জার্মানিতে থাকাই নয়, দুই দেশ, দুই মহাদেশ, দুই ভাষা, দুই সংস্কৃতিকে যে কী নিবিড় মমতায় তিনি নিত্যনিয়ত গেঁথেছেন তাঁর অনন্য মেধা ও মননে, বিচিত্র গদ্যে ও কাব্যে, তার ইয়ত্তা নেই! হয়তো বহুপঠিত, বহুচর্চিত নন অলোকরঞ্জন। একেবারেই নন গণকবি। তিনি আসলে 'ক্লাস'। যে-'ক্লাস', যে-দ্যুতি, যে প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞান থেকে ইদানীং বঞ্চিতই থেকেছে বাংলাসাহিত্যের জগৎ। অলোকরঞ্জনও আমাদের কাব্যজগৎকে বড় শূন্য করে দিয়ে গেলেন।
তিনি না থাকলে কে দেখবে পিছন-দরজা দিয়ে বারাঙ্গনার মন্দিরপ্রবেশ? 'বুদ্ধমন্দিরের দরজা বন্ধ হয়ে গেলে/এক বেশ্যা ঢুকে যায় পেছন-দুয়ার ঠেলে'! তিনি না থাকলে কে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে বদলে যাওয়া আগম-নিগম? 'হঠাৎ দেখছি/হলদিয়া মাঠে/বদলিয়ে গেছে/আগম-নিগম:/বুড়োরা খেলছে/শিশুরা দেখছে'!
হ্যাঁ, তাই আমাদের মনে রাখতেই হয়, পাতার ঝরে যাওয়া এবং পল্লবের জেগে ওঠার পারম্পর্যকে। না হলে শক্তি পাব কী করে? না হলে আরও প্রবল গতিতে কী করে এগিয়ে যাব আমরা আরও নতুনের উজ্জ্বল উদ্বোধনের দিকে?
শঙ্খচিল-কাক-শালিখের এই শীতকুয়াশামাখা বাংলা, হিজল-কাঁঠাল-বটের মধুর ছায়াভরা এই বাংলা, কলমির গন্ধভরা জল, নদীমাঠখেতের অপার বিষণ্ণতাময় বাংলা, নীল জ্যোৎস্না, সোনালি ধানের উদাসীনতাভরা বাংলা, শ্যামার গান, খঞ্জনার নাচের রোমাঞ্চভরা এই বাংলা-- তবু ফিরে তাকাবে শোকের দিকে আবারও নতুন করে এগিয়ে চলার জন্যই।
Also Read: শান্তি নেই নতুন বছরেও, ২০২১ নিয়ে নানা বিপদের ভবিষ্যদ্বাণী নস্ত্রাদামুসের