নাটকের সাজানো-বাগান শুকিয়ে গেলে জাতির কপালে দুঃখ আছে
আরও-আরও বিবর্তন-আলোড়নের মধ্যে দিয়ে আরও কোনও বিপুল মোহানার দিকে বয়ে চলবে নাটক।
সৌমিত্র সেন
নাটক হল যে কোনও জাতির সংস্কৃতির অন্যতম অভিজ্ঞান। যে জাতির নাটক নেই, সন্দেহ নেই সে জাতি দীন-হীন।
কেন নাটক এত গুরুত্বপূর্ণ?
কাব্য, সঙ্গীত, নৃত্যের সঙ্গে নাটকের (Theatre) মূলগত ফারাক আছে। নাটক আসলে প্রতিবাদের হাতিয়ার। শিল্পসৃষ্টির আধারেই নাটক জীবনের বঞ্চনার কথা বলে, ন্যায্যতার প্রশ্ন তোলে। নিপীড়িতের পাশে দাঁড়ায়। গিরিশ কারনাড তো বলেওছিলেন, থিয়েটার যখন সমকালীন সমস্যা এড়িয়ে নিরাপদে থাকার চেষ্টা করে তখনই সে তার নিজের মৃত্যুপরোয়ানায় স্বাক্ষর করে!
আন্তর্জাতিক থিয়েটার ইনস্টিটিউট ১৯৬১ সালে প্রথম এই ওয়ার্ল্ড থিয়েটার ডে (World Theatre Day) পালন করে। দিনটি উদযাপন করতে বিভিন্ন দলের নাটক মঞ্চস্থ করা হয়। প্রত্যেক বছর এই দিনে মেসেজ দেন প্রখ্যাত ব্যক্তিত্বরা। এটা শুরু হয়েছিল ১৯৬২ সালে জাঁ ককতোর (Jean Cocteau) বার্তা দিয়ে।
সভ্যতার খুব আদি জিনিস এই নাটক। এ দেশে ভরত মুনি ছিলেন প্রাচীন নাট্য ও সঙ্গীত বিশারদ। তিনি ভারতীয় নাটক, বিশেষ করে সংস্কৃত মঞ্চনাটক, ও অভিনয়বিদ্যা বিষয়ক নাট্যশাস্ত্র রচনা করেছেন। ভরতকে ভারতীয় নাট্যের জনকও বলা হয়। তাঁর রচনার সময়কাল নির্ধারণ করা যায়নি। তবে অনুমান, এটি খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতাব্দী থেকে খ্রিস্ট্রিয় ২য় শতাব্দীর মধ্যে রচিত।
তবে আধুনিক কালে যে নাটককে বিশ্ব জুড়ে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, তার উদ্ভব ধরা হয় গ্রিক সংস্কৃতিতেই। ডায়োনিসাস দেবতার সম্মানে গ্রিস দেশে যে উৎসব পালিত হত, সেই উৎসবকে কেন্দ্র করেই নাটকের প্রথম উদ্ভব বলে বলা হয়। জানা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৪ সালে প্রথম নাটক অভিনীত হয়। গ্রিক নাটকের আদিরূপের জন্মদাতা এস্কাইলাস। তিনিই নাটকে সমস্বর বা বহুস্বরের মধ্যে আলাদা করে সংলাপের গুরুত্ব প্রথম উপলব্ধি করেছিলেন। গ্রিক নাটকের ইতিহাস রচনা করেন অ্যারিস্টটল। তাঁর নাট্য বিষয়ক ধারণাই পরবর্তী যুগগুলিকে প্রভাবিত করে রাখে।
Oscar Wilde একদা বলেছিলেন, 'সমস্ত আর্ট ফর্মের মধ্যে নাটককেই আমি সর্বোচ্চ ফর্ম মনে করি।' তিনি আরও বলেছিলেন, একজন মানুষ দ্রুত তার মানবিক অনুভূতিগুলি নিয়ে অন্য মানুষের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে একমাত্র নাট্যমাধ্যম মারফতই।
খুব সত্যি কথা। একটু ভেবে দেখলেই দেখা যাবে আমাদের প্রথম আধুনিক কবিও নিজেকে কবিতাতেই আবদ্ধ রাখেননি। রচনা করেছিলেন বাংলার প্রথম সার্থক নাটকও। মাইকেলের হাতেই বাংলা নাটকের যথার্থ আরম্ভ।
তার পরে কত ভাবেই না নাটক তার পথ করে নিয়েছে। কত ধারা তৈরি হয়েছে। দীনবন্ধু মিত্র, গিরিশ ঘোষ, ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যোবিনোদ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রবীন্দ্রনাথ।
নাটক শুধু লেখা তো নয়, নাটক তো দৃশ্য়ও। সেই দৃশ্যশিল্পের রূপায়ণেও কত জন কত ভাবনা ভেবেছেন। শিশির ভাদুড়ী, শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত কত ভাবে নাটকের কলাশিল্পরূপ নিয়ে ভেবেছেন।
আজও নাটক বয়ে চলেছে। শুধু বাংলা নয়, ভারতে, বিশ্বেও নাটক কখনওই শুধু শিল্পমাধ্যম নয়, প্রতিবাদের একটা স্পেস হিসাবেই স্বীকৃত হয়ে আরও-আরও বিবর্তন আলোড়নের মধ্যে দিয়ে আরও কোনও বিপুল মোহানার দিকে বয়ে চলেছে, বয়ে চলবেও।
আরও পড়ুন: WB assembly election 2021: 'আমি অন্য কোথাও যাব না, আমি এই দেশেতেই থাকব'