শেষ বেলায় আবার শুরু, ফিরে এল ইচ্ছে-ম্যাজিক
শর্মিলা মাইতি
ছবির নাম- বেলাশেষে
রেটিং- ****
১৯৮৪ সালে ঘরে-বাইরে ছবি মুক্তি পাওয়ার পর আলোচনার অন্যতম আকর ছিল সৌমিত্র-স্বাতীলেখার সেই চুম্বনদৃশ্য। ঘর ও বাইরের পৃথিবীর সন্ধিস্থলে দাঁড়িয়ে এক গৃহবধূর অভিজ্ঞতা। যা হয়ত ভবিতব্য ছিল। ঘটনাক্রমই হয়ত এগিয়ে দিয়েছিল সেই মুহূর্তটির দিকে। সত্যজিত্ রায়, যিনি এই ছবির, এই দৃশ্যের স্রষ্টা, তিনিও কতটা দূর ভেবেছিলেন জানা নেই। তবে নারীর অন্তর্দ্বন্দ্বের জগতে এই দৃশ্যের একটি স্থায়ী, অননুকরণীয় ও বহুমুখী প্রভাব থেকেই গেছে। তিনটি বিশেষণই খুব ভেবেচিন্তে প্রয়োগ করা হল, কারণ রবীন্দ্র-উপন্যাস আধারিত এই ছবি বাঙালির ঘরের অনেকগুলো পাথরই সরিয়ে দিয়েছিল।
২০১৫ সালে সেই পরিবর্তনের ঝড়টা অনেক স্তিমিত। এখন আর ঘরে-বাইরের দ্বন্দ্বটা সেই মাত্রায় নেই। প্রকৃতি অনেক বদলেছে। বেলাশেষের গোধূলি আলোয় এই জুটিকে আবার পর্দায় এনেছেন শিবপ্রসাদ ও নন্দিতা। সৌমিত্র পক্ককেশের বৃদ্ধ। পৃথুলা স্বাতীলেখা তাঁর সহধর্মিণী। জীবনের সরণি বেয়ে, সংসারের চড়াই-উত্রাই ধরে অনেক পথ এগিয়েছেন। প্রবীণ হয়েছেন।
নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ জুটির একটি অন্যতম সত্য- তাঁর অতিরিক্ত মেদ না জমিয়ে সরলভাবে গল্প বলতে জানেন৷ তাঁদের রুপোলি পর্দায় ডানা মেলে সারল্য, দর্শক যেমনই হোক মন-ছোঁয়ার পর্বটা ঠিক গুছিয়ে নিতে পারেন। ‘ইচ্ছে' থেকে ‘মুক্তধারা', ‘অ্যাক্সিডেণ্ট' থেকে ‘অলীকসুখ', ‘রামধনু' থেকে ‘বেলাশেষে', সবেতেই এই ব্যাপারটা কমন পাবেন৷
বছর দশেক আগে এক পত্রিকার পাতায় আইনী পরামর্শ কলামে একটি অদ্ভুত চিঠি নজর কেড়েছিল। এক ষাটোর্ধ বৃদ্ধা চাইছেন তাঁর স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্স। কারণ, তাঁর দুই সন্তান এখন সুপ্রতিষ্ঠিত। আর কোনও বাঁধনেই বাঁধা থাকতে চান না তিনি। বেলাশেষে দেখতে এসে প্রথমেই সেই স্মৃতির কড়া নড়ল। তখনও বুঝিনি, ঘর আর বাইরের দ্বন্দ্ব এই যুগে এসে কতটা বাঁক মোড় নিয়েছে!
প্রকাশনা ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত সাহিত্যপ্রেমী বিশ্বনাথ মজুমদার (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) দুর্গাপুজো উপলক্ষে ছেলে (শংকর চক্রবর্তী), ছেলের বউ (ইন্দ্রাণী দত্ত), তিন কন্যা (অপরাজিতা আঢ্য, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত ও মনামি ঘোষ) এবং তিন জামাইকে (খরাজ মুখোপাধ্যায়, সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায় এবং অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়) একসঙ্গে ডাকেন। সবাইকে অবাক করে দিয়ে জানান, পাঁচ দশকের দাম্পত্য জীবনে ইতি টানতে চান তিনি৷ স্ত্রী আরতির (স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত) সঙ্গে ডিভোর্সের জন্য যাবতীয় আইনী ব্যবস্থা তিনি ইতিমধ্যেই সেরে ফেলেছেন৷ কিন্তু কেন? দু'জনের দাম্পত্য জীবনে কোনও বিবাদ নেই৷ সন্তানদের বিস্ময়ে হতবাক করে দিলেন তিনি। সংসারের স্বাভাবিক গতি মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে গেল যেন!
এর পরের কাহিনিটা বাঁধা বেশ শক্ত কাজ ছিল। অতিরিক্ত মেলোড্রামায় তলিয়ে যেতে পারত। তা হল না। সৌমিত্রের অভিজ্ঞতায় শান দেওয়া অভিনয়, সব কলাকুশলীদের প্রাণঢালা, মনঢালা স্পর্শ অন্য একটা চিত্রনাট্য বের করে আনল, যাতে জুড়ে গেলেন সব বয়সের দর্শক। একের বেশিবার ছবিটা দেখে নেওয়ার জন্য যা যা উপাদান দরকার, তার প্রায় সব কটিই জড়ো করে দিয়েছেন পরিচালক। আপনা থেকেই তৈরি হয়েছে হৃদয়ের টান। ভোকাট্টা হতে গিয়েই খোলা আকাশে পতপত করে উড়ে গিয়েছে দুটো-জীবনঘুড়ি। অনুপম ও অনিন্দ্যর গানও ভরিয়ে দিয়েছে বাতাস। হালকা হাওয়ায় আরও আরও উঁচুতে উঠছে যেন।
সবচেয়ে বড় পাওনা- মেসেজ। যেটা এই পরিচালক-দ্বয় দিতে চেষ্টা করেন প্রতিটি ছবিতে, এবং এ ছবিতে খুব সফলভাবেই দিতে পেরেছেন এখানে। ঋতুপর্ণার অভিনয় যেমন মনে থাকবে, তেমনি মনে থাকবে খরাজ-অপরাজিতার নির্মেদ স্বচ্ছ কেমিস্ট্রি। পারিবারিক ছবি সংজ্ঞায় এক নতুন মাত্রা অবশ্যই যোগ করার দাবি রাখেন শিবপ্রসাদ নন্দিতা।
আর দর্শক, হাসতে হাসতে, চোখের জলে ভাসতে ভাসতে দেখেছেন ছবি। পাঁচ বছর আগের ইচ্ছে ছবির হ্যামলিনের এমন প্রত্যাবর্তন হবে, কে জানত। কত দিন হল রিলিজের যেন? প্রতিদ্বন্দ্বীকে একেবারে “নির্বাক” করে দিয়ে, মাউথ পাবলিসিটিতেই হল ভর্তি হয়ে চলেছে!