গত ৫ বছর অবহেলা সওয়ার পর ৬ টি চোখা প্রশ্ন মমতা - সূর্য - আপনাকেও
স্বরূপ দত্ত
আর মাত্র কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষা। তারপরই জানতে চলেছি গত ৫ বছরের সবথেকে বড় পরীক্ষার ফল। কে বসবে আবার বাংলার মসনদে? গত ৫ বছর যাঁরা চালাচ্ছিলেন তাঁরাই? নাকি তার আগের ৩৪ বছর যাঁরা শাসন করেছিলেন, তাঁরাই ফের সরকার গঠন করবেন কংগ্রেসের হাত ধরে? সবারই কৌতুহল। কিন্তু নিশ্চিত জানা নেই কারও। সবাই অধীর আগ্রহে বসে রয়েছে জানার জন্য, আগামী ৫ বছর কোন অভিভাবকের মুখ চেয়ে থাকবেন তাঁরা।
আপনাদের কথা তো গেল। অবশ্য, আপনারা অন্যের খোঁজ কে কতটাই বা রাখতে আগ্রহী? আপনার যদি এই কথাটা খুব গায়ে লেগে থাকে, তাহলে বলি-আজ যে আমি বলছি, গত ৫ বছরে নতুন সরকার আসার পর আমিই ছিলাম সবথেকে অবহেলিত। আজও অবহেলার চূড়ান্ত শিকার আমি। এবং, আগামিদিনগুলোতেও সম্ভাবত, থাকতে চলেছি সেটাই। ঐতিহ্য, সম্মান আর গর্বের আমি, এখন আপনাদের অবহেলায় আার বঞ্চনায় গুরুত্বহীন হয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছি।
হ্যাঁ, আপনারা এখন আমায় চিনতেও পারেন না। আমি রাইটার্স বিল্ডিং বলছি। আপনাদের মহাকরণ। সেই ১৭৭৭ সাল থেকে ধর্মতলার মোড়ে গর্বিত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। দাঁড়িয়ে তো আজও আছি। শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনের ওই বটগাছটা আর আমি কলকাতাটাকে কবে থেকে দেখে যাচ্ছি। আমাদের সময়কার অনেককিছুই রয়ে গিয়েছে আজও। অদ্বৈতদের মতো কেউ কেউ আমার সমবয়সীরা চলে গিয়েছে আমাদের ছেড়ে। আজ বিধানসভা নির্বাচনের ফলের আগে কয়েকটা কথা বলতে ইচ্ছে করছে খুব। দীর্ঘশ্বাস চেপে রেখেছিলাম গত চারটে বছর ধরে। আজ বুক থেকে পাথরটা না সরালে আর কষ্টটা সহ্য করতে পারছিলাম না। বুক ফেটে, মুখও ফাটলো আজ। তাই খুব বিনীতভাবে আজ কয়েকটা প্রশ্ন আমার, রাজনৈতিক নেতাদের, আপনাদেরও -
১) এ রাজ্যটা বরাবরই চলতো আমার শরীরের উপর ভর করে। সেই যে ২০১৩ সালে এক এক করে আমার শরীর থেকে ফাইল, আসবাবগুলো নিয়ে চলে গেল, আর ফিরল না কেউ। আমার নাকি নতুন রূপ হবে। কোথায় কী! আমার শরীরে এখন শুটিং হয়! অথচ, এ রাজ্যটায় আমার যা গুরুত্ব ছিল, তা আজ কে মনে রেখেছে! খুব মন খারাপ করে চলে যাওয়া লোকগুলোও আর কোনওদিন এসে দেখে যায়নি আমায়, কেমন আছি আমি! মানুষ চিনলাম এই চার বছরে। হ্যাঁ, আপনাকেও। কবার এসেছেন আমায় দেখতে?
২) এতদিন শুনতাম, জানতাম, চারিদিকে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাচ্ছে। সমাজের প্রত্যেকটা ক্ষেত্রেই প্রতিযোগিতা আর প্রতিযোগিতা। আমার দখল নেওয়ার জন্যও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে প্রতিযোগিতা চলত, তা খুব উপভোগ করতাম। কিন্তু হঠাত্ দেখলাম, আমারও প্রতিযোগী তৈরি হয়ে গেল। সে থাকে গঙ্গার উপর। নতুন নীল-সাদা নবান্ন নামের বাড়িটা আমার বুক থেকে সব কেড়ে নিলো!
৩) জানি না কাল নির্বাচনে কে জিতবে। যাঁরাই জিতুন, তাঁরা কি আর আমায় গুরুত্ব দেবেন সেই আগের মতোই? বাম আমলে আমার গায়ে হয়তো অনেক ধুলো জমেছিল।তবু, আমার গৌরব ছিল অনেক। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এসেছিলেন আমার কাছেই শুরুতে। কিন্তু আমায় সারিয়ে ফের আসবেন, প্রতিশ্রুতি দিয়ে আর কখনও এদিকে আসেননি। আচ্ছা, বলুন তো, আমি কি আবার আমার গুরুত্ব, সম্মান ফিরে পাবো কোনওদিন? নাকি নতুন রঙে সেজে উঠে, সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ থেকে 'মাকালফলেই' পরিণত হবো?
৪) আজব একটা 'ইগো' দেখলাম মানুষের মধ্যে। এর আগের সরকারের মানুষরা রাজ্য চালাতেন এখানে বসেই। পরিবর্তনের সরকার এসে, আমায় কেন ছেড়ে চলে গেল! যদি আগের লোকেরা খারাপ হয়ে থাকে, তাতে আমার দোষ কোথায় ছিল! আমি তো আর খারাপ ছিলাম না। যদি এটা মনে হয় কারও যে, আমার শরীরে বসে অনেক অনেক খারাপ কাজ হয়েছে। তাহলে আমার গা থেকে কাদা সরিয়ে নতুনরা তো কিছু ভালো কাজও করতে পারতেন আমার শরীরে বসে। মনটা ভালো লাগতো।
৫) আচ্ছা, সংস্কার করতে কত সময় ঠিক লাগে বলুন তো? আমি তো যে সে কেউ নই। আমি তো রাইটার্স বিন্ডিং। মহাকরণ। রাজ্যের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ চৌহদ্দি। সেটার সংস্কার কি আর একটু দ্রুতগতিতে করা যেত না? এই তো শুনি ভোটের আগে কাজ দেখাতে কত কত দুর্বল উড়ালপুলও পুরো 'রেডি' হয়ে যাচ্ছিল। আর আমার সংস্কার চারটে বছরেও হল না! এটা কি ঠিক বিচার?
৬) রাজনৈতিক নেতাদের দিকে আমার প্রশ্ন অনেক। কিন্তু বাদ যাবেন না আপনারাও। মানে, সাধারণ মানুষের নাম করে যাঁরা 'ঘোমটা টেনে, দায় ঝেড়ে ফেলে' বসে থাকেন, তাঁদের জন্যও আমার বিনীত প্রশ্ন, আচ্ছা, আমার সঙ্গে যেটা ঘটলো, সেটা যদি আপনাদের সঙ্গে ঘটতো কী বলতেন? ফেসবুকে স্টেটাস দিয়ে দিয়ে বুঝিয়ে দিতেন আপনি কত বঞ্চিত! আর আমায় আপনারা মনেও রাখলেন না! অথচ, নিজেদের কত দরকারি কাজ আপনারা সেরে গিয়েছেন আমার শরীরে এসেই। আজ আপনারা দিব্যি মানিয়ে নিয়েছেন নবান্নের সঙ্গে। আপনার কাছে নবান্নও যা, মহাকরণও তাই। দুটোই আপনাদের কাছে 'লঙ্কা'। ধিক আপনাদের। সত্যিই পুরোনোকে, ঐতিহ্যকে সম্মান দিতে আপনাদের এখনও অনেক শিখতে হবে। মনে হয় না, সেটা আপনারা কোনওদিন পারবেন বলে। আপনারা মানে, শাসক থেকে জনগণ ঠিক কতটা স্বার্থপর 'সংস্কার' না হলে বুঝতে পারতাম না। ধন্যবাদ।
(আজ রাইটার্স বিল্ডিংয়ের দেওয়ালটা একটু ছুঁলাম অফিস আসার আগে! অত বড় ইমারতটা কানের কাছে এসে এগুলোই বলল!)