দেশ
আমি লিখতে চেয়েছিলাম বেশ কয়েকটি মৃত্যুর কথা। মৃতেরা প্রত্যেকেই আমাদের দেশের সন্তান। ধূপকাঠি বিক্রেতা, স্টেশনের অন্ধ ভিখারি, দৌড়বাজ পার্টনার, রেডিওর জিঙ্গল গায়ক, উড়ালপুলের নীচে ফাই ফরমাশ খাটিয়ে আট বছরের টগর, তাকে লক্ষ্য রাখা মালিক, প্রত্যেকেই যেমন আমাদের দেশের সন্তান।
দুপুরের বাসে অন্ধদের তৈরি ধূপকাঠি কেউ কিনলেন না। যিনি বিক্রি করছিলেন তাঁর চেহারা দেখে বোধহয় যাত্রীরা তেমন একটা ভরসা পেলেন না। চোখে ভারী পাওয়ারের চশমা। জামা ময়লা। ওপরের দিকের বোতামগুলো নেই। ব্যাগে রাখা অন্ধদের তৈরি ধূপকাঠির মতই তাঁর স্বর অস্ফুট এবং মায়াময়। কিন্তু আজকাল লোকজন মায়াটায়া পছন্দ করে না। অনেকেই তাই 'টেক্সটিং'-এ ব্যস্ত থাকলেন। মগ্ন থাকলেন এফএম সংগীতে। সেখানে বিজ্ঞাপানীয় জিঙ্গলে বাস্তু সমাধান থেকে প্রিন্ট, টিভি, ফুড ইত্যাদি প্রভৃতি প্রতিযোগী দৌড়বাজ পার্টনাররা হাতধরাধরি করে বাজার করছেন। সেখানে যুগলে মোমবাতি শোভিত ঘনিষ্ঠ নৈশাহারের সুলুক শেষে নির্মলা মিশ্র ধরলেন...ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে আমি হয়ে গেছি তারা... অন্ধদের চোখে আকাশ নেই, নক্ষত্র-তারা নেই, অন্ধকার রয়েছে। তাঁরা মফস্বল স্টেশনে করতাল বাজিয়ে ভিক্ষে করছেন। ধুলো মাখা গাঁ-গঞ্জে কখনওবা অবহেলার বাটিতে এসে পড়ছে আট আনা, এক টাকা। ...এই জীবন ছিল নদীর মতই গতিহারা, দিশাহারা...
দুপুরের বাস এসে দাঁড়াল উড়ালপুলের পাশে। ধূপকাঠি বিক্রেতা নেমে গেলেন। উড়ালপুলের নীচে শীতের শেষবেলায় আট বছরের টগর চেয়ার টেবিল সব গুছিয়ে রাখছে। হাফপ্যান্ট পরে কাপ ডিশ, হাঁড়ি, কড়াই, ডেগচি ধুচ্ছে । মালিক লক্ষ্য রাখছেন সবকিছু।
কিন্তু লেখাটা আমি এভাবে শুরু করতে চাইনি। আমি লিখতে চেয়েছিলাম বেশ কয়েকটি মৃত্যুর কথা। মৃতেরা প্রত্যেকেই আমাদের দেশের সন্তান। ধূপকাঠি বিক্রেতা, স্টেশনের অন্ধ ভিখারি, দৌড়বাজ পার্টনার, রেডিওর জিঙ্গল গায়ক, উড়ালপুলের নীচে ফাই ফরমাশ খাটিয়ে আট বছরের টগর, তাকে লক্ষ্য রাখা মালিক, প্রত্যেকেই যেমন আমাদের দেশের সন্তান।
সত্তর বছরের ন্যুব্জ শরীর। বৃদ্ধ হাবিবুল্লাহ খান। তিন সন্তান তাঁর। বনেজঙ্গলে ঘুরে ঘুরে প্রতিদিন কাঠ, লকড়ি, টুকরি কুড়িয়ে, বিক্রি করে কোনওরকমে তাঁদের দিন গুজরান। নব্বই দশকের শুরুর দিকে হাবিবুল্লার এক সন্তান সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তান চলে যায়। আর ফিরে আসেনি। উনিশশো নিরানব্বইয়ের গ্রীষ্মকাল। বড় ছেলে আহমেদুল্লাহ জঙ্গলে ঢুকেছিল কাঠ সংগ্রহে। সেনাবাহিনী টহল দিচ্ছিল। ভাবল জঙ্গি। গুলি চালিয়ে খতম করে দিল। দু-হাজার তিনের দিকে শরীর স্বাস্থ্য একেবারেই ভেঙে পড়ল হাবিবুল্লাহর। কাছেই সোগাঁও শহর। মসজিদ, বাজার, মহল্লার ভিড়। সেখানেই প্রতিদিন ভিক্ষে করতে দেখা গেল হাবিবুল্লাহকে...
বাবা বাড়ি ফেরেননি টানা পাঁচ দিন। পুলিস স্টেশনে গিয়ে খোঁজখবর নিল উদ্বিগ্ন রাজ মুহাম্মদ। হাবিবুল্লাহর আর এক সন্তান। পুলিস অফিসার তাঁর মোবাইলে এক নিহতের ছবি দেখালেন। গুলিতে ঝাঁঝরা। ক্ষতবিক্ষত। রাজ দেখল ওর বাবা। ঘুমিয়ে আছেন।
গুলাম মহম্মদ মীর। জঙ্গি দমনকারী অফিসার হিসেবে তাঁর বেশ ইয়ে, 'সুখ্যাতি' আছে। খুন এবং তোলাবাজির বেশ কয়েকটি মামলা এখনও ঝুলে রয়েছে গুলাম মহম্মদ মীরের নামে। পদ্মশ্রীতে সম্মানিত হলেন। আর হাবিবুল্লাহ খান আমাদের দেশের একজন সন্তান, সবথেকে বয়োজ্যেষ্ঠ তথাকথিত জঙ্গি, পুলিস আর সেনার যৌথ অভিযানে গুলি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন ঘাসের জঙ্গলে।
ডেটলাইন মীরাট, ১১ এপ্রিল: খিদে আর সহ্য করা যাচ্ছিল না। ৬ ছেলেমেয়েকে সঙ্গে নিয়ে চুপিচুপি বাড়ির দরজা এঁটে দিলেন ৩৬ বছরের রাজ বালা। স্বামী বেকার, কর্মহীন। ভাত জোটাতে পারে না। ভাতের বদলে ছেলেমেয়েদের মুখে বিষ তুলে দিলেন রাজ বালা। তারপর নিজেও খেলেন। পান্নাপুরি গ্রামের পড়োশিরা দরজা ভেঙে ৭টি মৃতদেহ উদ্ধার করল। মাছি ভনভন করছিল।
থালাবাসন, হাঁড়ি, কড়াই, ডেগচি সব ঘষেমেজে সাফ করেছে টগর। এখন ঘাম মুছে বেঞ্চিতে এসে বসল। খিদে পেয়েছে। প্রতিদিনের বরাদ্দের থেকে আজ একটু উপরি। আজ মুরগির ঝোল আছে। সঙ্গে আলু। মালিক টাকা গুনছেন। বাস ইতিমধ্যেই উড়ালপুলে উঠে পড়েছে। দু-পাশে উঁচু ক্রেন। শহর বড় হচ্ছে। স্কাইস্ক্র্যাপারের থুতনিতে শেষ বিকেলের আলো হাত রেখেছে...
(চলবে)
সাম্যব্রত জোয়ারদার