আমরা বেসেছি যারা...
তার অপেক্ষাতেই ছিল সবাই। অবশেষে সে এল, একেবারে নিঃশ্বব্দেই। কাল কিছুটা অন্যমনস্ক হয়েই আলমারি থেকে বের করে চাপিয়ে নিলাম ফুলহাতা সোয়েটারটা। তারপরেই একটা উষ্ণতার অনুভূতি পেলাম। চমকও ভাঙল তখনই। বুঝলাম শীত এল।
তার অপেক্ষাতেই ছিল সবাই। অবশেষে সে এল, একেবারে নিঃশ্বব্দেই। কাল কিছুটা অন্যমনস্ক হয়েই আলমারি থেকে বের করে চাপিয়ে নিলাম ফুলহাতা সোয়েটারটা। তারপরেই একটা উষ্ণতার অনুভূতি পেলাম। চমকও ভাঙল তখনই। বুঝলাম শীত এল। বর্ষা ছিল রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ঋতু। আর শুধু রবীন্দ্রনাথই বা কেন , সেই কালীদাস থেকে শুরু হয়েছে বর্ষা বন্দনা। 'আষাঢস্য প্রথম দিবস মেঘমাস্লিষ্ট সানুং, বপ্রক্রীড়া পরিণতগজ প্রেক্ষনীয়ং দদর্শ'। তবে বর্ষা প্রিয় ঋতু হলেও শীতকাল নিয়ে কম ফ্যান্টাসি করেননি রবীন্দ্রনাথ। ছিন্নপত্রাবলী পড়লে তা টের পাওয়া যায়। আর তাঁর গান। 'শীতের হাওয়ায় লাগল নাচন আমলকির ওই ডালে ডালে' বা 'পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে আয় রে ছুটে আয়' এমন আরও অজস্র।
তা সত্বেও শীতকে খুব নিবিড় করে আমরা পাই হেমন্তের কবি জীবনানন্দেই। 'আমরা বেসেছি যারা, দীর্ঘ শীত রাত্রিটিরে ভাল', তাদের জন্য জীবনানন্দ। দিনের প্রতিটি সময় জেগে থাকে এক আশ্চর্য সুষমায়। শীতের সকাল শুরু হয় কুয়াশামোড়া চাদরে। সেই কুয়াশার আস্তরণ সরিয়ে রোদ ঝলমলে আকাশের নীচে যখন দাঁড়াই আমরা, তখন শীতের তীব্রতার ওপর নরম আলোর মতো জড়িয়ে ধরে রোদ্দুর। বেলা গড়িয়ে সন্ধে নামে আগেই, সেই সন্ধেই আমরা হেঁটে চলি কবির সঙ্গে ।
'আমরা হেঁটেছি যারা, নির্জন খড়ের মাঠে পউষ সন্ধ্যায়/আমরা বেসেছি যারা দীর্ঘ শীত রাত্রিটিরে ভাল'।
দীর্ঘ শীতরাতে অফুরান গন্তব্য। দীর্ঘ শীতরাত্রির মতোই দীর্ঘ পথ। সেই 'অরব অন্ধকার' পেরিয়ে কবি দাঁড়ান এক আলোছায়াময় সন্ধিতে, যেখানে রয়েছে 'মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন'। আবার কখনও বা অন্যরকম শীতরাত্রিও আছে কবির।
'ধানসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়ে থাকবো -ধীরে-পউষের রাতে-/ কোনোদিন জাগব না জেনে- /কোনোদিন জাগব না আমি-কোনোদিন আর'। এইসব রাতে যাঁর জীবন সম্পর্কে সব মোহ চলে যায়
তিনিই তো লিখতে পারেন 'এইসব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে'। কিংবা 'আঁধারে হিমের রাতে আকাশের তলে /এখন জ্যোতিষ্ক কেউ নেই।'
তখন কবি শীতার্ত।
আবার এই শীতেই কবি জেগে ওঠেন অদ্ভুত প্রত্যয়ে,
'মকরক্রান্তির রাত অন্তহীন তারায় নবীন/ -তবুও তো পৃথিবীর নয়, /এখন গভীর রাত, বহু কালপুরুষ,/
তবু পৃথিবীর মনে হয়'। তাই তো শীতেই 'মৃত্যুর আগে' বলা যায়, 'আমরা বুঝেছি যারা জীবনের এইসব নিভৃত কুহক।'
সোমশুভ্র মুখোপাধ্যায়