যতীনদাসের দুগ্গা
আমাদের ছেলেবেলার দুর্গা দু'জন; আমাদের কলোনির দুর্গা, আমাদের যতীন দাস নগরের দুর্গা। একজনের নাম ছিল সেন্ট্রালের দুর্গা, অন্যজন পূর্বাশার দুর্গা। সেন্ট্রালের দুর্গাপ্রতিমা দেখলে মনে হত খুব চেনা মুখ। যেন এই মাত্র বলে উঠবেন, আয় দুধ-মুড়ি খেয়ে পড়তে বস। আর পূর্বাশার দুর্গা? রণরঙ্গিনী তার রূপ। আমাদের শৈশবের রণপ্ররোচনা।
শিউলি ফুটেছিল। গন্ধ ভেসে এসেছিল কি? মনে নেই। উনুনের ধোঁয়া গন্ধ দিয়ে মুড়ে রাখত শরত্-এর ভোরগুলিকে। আমার মা উনুনে আঁচ দিতেন। শিবের জটার মতো ধোঁয়াকুণ্ডলি ভেসে যেত কৈলাশের দিকে। আমি ঘুম ঘুম চোখে পৌঁছে যেতাম কুমোরটুলিতে, দুর্গার কাছে, ওনার পুত্র কন্যাদের কাছে। অসুরের কাছে, এমনকি সিংহ, মহিষ, ইঁদুর, ময়ুর, পেঁচা ও হাঁসের কাছে। তখনও তারা খড়ের। আর তখনও খড়ের যে কোনও কাঠামোকে দেখলেই মনে পড়ত ঘোলা রোড়ের গোয়ালের কথা, খড়ের বাছুরের কথা। দুগ্ধপ্রতারনা।
আমাদের ছেলেবেলার দুর্গা দু'জন; আমাদের কলোনির দুর্গা, আমাদের যতীন দাস নগরের দুর্গা। একজনের নাম ছিল সেন্ট্রালের দুর্গা, অন্যজন পূর্বাশার দুর্গা। সেন্ট্রালের দুর্গাপ্রতিমা দেখলে মনে হত খুব চেনা মুখ। যেন এই মাত্র বলে উঠবেন, আয় দুধ-মুড়ি খেয়ে পড়তে বস। আর পূর্বাশার দুর্গা? রণরঙ্গিনী তার রূপ। আমাদের শৈশবের রণপ্ররোচনা।
পূর্বাশার দুর্গা পুজো, কলোনির একমাত্র সিনারির পুজো সিনারির নির্মাতার নাম বিলকুল মনে আছে। যেমন মনে আছে রূপান্তর টেলার্সের নাম। রূপান্তরের মালিক শান্তির নাম। শান্তি কলোনির নাচের দলে কালি সাজত। প্রায় মধ্যরাতে চোখ কচলাতে কচলাতে দেখতাম, নাচের আগে পরে শান্তি, মা কালি, পাঁচিলে পা দোলাতে দোলাতে বিড়ি টানছে। তার এক হাতে বিড়ি, আরেক হাতে কালির টকটকে লাল জিহ্বা। তো সেই সিনারি নির্মাতার নাম ছিল দীপক ভট্টাচার্য। তিনি আমার জীবনের প্রথম জাদুকর। তিনি আমার লতা-পাতার আত্মীয়। তাঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ পর রাস্তায় ঘুরে ঠাকুর দেখব, চিনব পুজোর শহর, পুজোর কলিকাতা। সে আরেক কাহিনি।
পুজোর প্রায় দিন পনেরো আগে থেকেই পূর্বাশার মণ্ডপ হয়ে উঠত আমার ম্যাজিক স্কুল। কাপড়ের পটে আঁকা হত আকাশে, উড়ে যেত পাখি। তৈরি হত পাহাড়, চটের পাহাড়, এর ওপর সবুজ উপত্যকা। উপত্যকায় দুর্গা আসবেন। তৈরি হচ্ছে আবহ।
এতদিনে কুমোরটুলিতে খড়ের ওপর মাটির প্রলেপ। রং করা হত প্রতিমার মুখ, গলা,হাত। ছাঁচের চোখে তুলি বোলান হত। দুর্গা,লক্ষ্মী,সরস্বতীর এবড়ো খেবড়ো প্রায় সর্বাঙ্গ আর অসুর, গনেশ, কার্তিকের নিম্নাঙ্গ ঢেকে যেত কাপড়ে। শুধু চোখের মণি, সেই গোলাকার মরকত আঁকা হত না তখনও। মহালয়ার ভোরে হত চক্ষুদান। তারপর প্রতিমা মণ্ডপে, মণ্ডপে।
পূর্বাশার মণ্ডপেও এসে গেছে প্রতিমা। তবে একটু অন্যরকম। কিছুটা বাঁকা, উড়ন্ত ভঙ্গিমা। একটি বাঁশ প্রতিমার পিঠ সর্বস্ব পশ্চাত্-এ গেঁথে দেওয়া। এই বাঁশটিই দুর্গার একমাত্র অবলম্বন। পা শূন্যে, বাঁশ মাটিতে। বাঁশটি আবার পাহাড়ের চটে ঢাকা, একই ভাবে উড়ন্ত কার্তিক, গনেশ, সরস্বতী, ময়ূর, পেঁচা, হাঁস শুধু লক্ষ্মী উড়তেন না। তিনি ঝাঁপি কাঁখে সমস্ত ক্রীড়াকলাপের সাক্ষী। আর অসুর? মরিয়া অসুর, তীরবিদ্ধ অর্ধেক মহিষ ও অর্ধেক অসুর? তার দিকে উড়ে আসছে তীর, ত্রিশূল, চক্র, ভল্ল। দীপক ভট্টাচার্য বললেন, এই ধর কালো তার, ত্রিশূলের লেজে আর মাথায় শক্ত করে বাঁধ। বাঁধলাম। দীপক ভট্টাচার্য মণ্ডপের ছাদ থেকে ঝুলিয়ে দিলেন। এবার বললেন, বাইরে গিয়ে দূর থেকে দেখ। অন্তত ৮ ফুট দূর থেকে। কি, আর বোঝা যাচ্ছে? মাথা নাড়ালাম, না। তিনি আমার দিকে এগিয়ে এসে যেন দ্রোনাচার্য বললেন, বুঝলি আর্টে দূরত্বই একমাত্র সত্য। আমি দূরত্ব জানলাম। আমার অন্যতম কবি একরাম আলির পংক্তি দূরত্ব অধিক সত্য, দূরত্ব 'গগন' যখনই মনে আসে আমি যেন দীপক ভট্টাচার্যকে দেখতে পাই, দেখতে পাই বছর ১১/১২-র আমাকেও।
তারপর পুজো আসে, কলোনির পুজো। যে বছর মোহিনি মিল বন্ধ থাকে, পুজোর রঙ ম্লান। খোলা থাকলে আপাত উজ্জ্বল। মোহিনি মিল তখন বেলঘরিয়ার অর্থনীতিকে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রন করে বললে ভুল হবে না। নিয়ন্ত্রন করত পুজোর আনন্দকেও। পুজোর চারদিন-পাঁচদিন, তারপর ঢাকের বোলে বিসর্জনের বাদ্যি। মণ্ডপ খাঁ খাঁ। শূন্য মণ্ডপে প্রদীপ জ্বলছে। প্রদীপের আলো আমাদের আকাঙ্খা। আসছে বছর আবার হবে। আবার দেখা হবে যতীন দাসের দুগ্গা।
রাহুল পুরকায়স্থ
(মুখ্য প্রযোজক)