পার্ক স্ট্রিট ও একটি মেয়ে

তখনই প্রশ্ন জাগে, রেনেসাঁগর্বিত বাঙালি, আমরা আধুনিক হলাম না এখনও? মেরুকৃত আমরা, ইদানিংকালে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে (সঙ্গে সঙ্গে আট মাস বনাম চৌত্রিশ বছরের ব্যালান্সশিট খুলে বসে শতাংশের হিসেবে একে অপরের মুখোমুখি আমরা), অথবা সার্বিকভাবে নারী পুরুষ বিভাজনের ঊর্ধে উঠে সত্যকে বিচার করার মতো প্রতিস্পর্ধী অবস্থানে আসতে পারব না আমরা?

Updated By: Feb 17, 2012, 07:08 PM IST

অতএব আমি নিশ্চিন্ত হলাম। নিশ্চিন্ত নিদ্রায় যাওয়ার ক্ষেত্রে বিবেকের খচখচ থেকে মুক্ত হলাম। মন্ত্রী স্বয়ং বলে দিয়েছেন, দু সন্তানের মা, স্বামীবিচ্ছিন্না, অত গভীর রাতে নাইট-ক্লাবে কী করছিলেন, অ্যাঁ?

অ্যাঁ? আমাদেরও প্রশ্ন, অ্যাঁ? দুই সন্তানের পিতা, স্ত্রীবিচ্ছিন্ন পুরুষ হলে আপনার প্রতি আমার সমবেদনা থাকত। আপনাকে একটু রিল্যাক্স করার সুযোগ দেবে না সমাজ? একটু উতলা হলেনই বা, আপনি রিল্যাক্স করছেন তো!... কিন্তু নারী...

অতএব, নিশ্চিন্ত হই লজিকের জাল বুনে। অত রাতে নাইটক্লাবপনার কী দরকার ছিল? গেলেই যদি বা, লিফ্‌ট নিলে কেন? জান না কী হতে পারে লিফ্‌ট নিলে, তাও আবার অত রাতে? তুমি হলে হরিণা মাস, হরিণ মাংস, আপনা মাসে তুমি বৈরী। প্রলুব্ধ কয়েকজন পুরুষ, আহা রিল্যাক্সিং পুরুষ, তাদের সামনে যাওয়ার দরকার ছিল তোমার? মদ খেয়েছিলে? পোশাক কী ছিল তোমার? আচরণটা মধ্যবিত্তসুলভ ছিল কি? এই পরীক্ষায় পাশ হয়ে এস। তারপর বিচার করা যাবে তুমি ধর্ষিতা হলে কি না!

এই তাহলে বিচার। এই তাহলে আমাদের সমাজবুদ্ধি। পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডের পর চুলচেরা বিশ্লেষণের আতসকাচের নীচে দাঁড়িয়ে আসলে আমরাই।

আর তখনই একটু অধোবদন হই। ঝমঝম শব্দ অনেক এই আধুনিকতার, সমানাধিকারে সোচ্চার এই নাগরিক বিবেক। কিন্তু কোথাও থেকে গেল না তো উনিশ শতকের বীজ? এক মহিলা ধর্ষণের নিদারুণ অভিযোগ নিয়ে সমাজের সামনে দাঁড়াচ্ছেন। পুলিস- উদাসীন, অসংবেদনশীল, শ্লেষ এবং শ্লেষ্মাসমৃদ্ধ পুলিস, বক্রোক্তিতে- বিদ্রুপে- অশালীন আহ্বানে গ্রহণ করছে তাঁকে। মন্ত্রীরা গ্রহণ করছেন নীতিপুলিসের বিচারবুদ্ধি দিয়ে। মিডিয়ার একাংশ গ্রহণ করছে 'সরকারের বদনাম চক্রান্ত' আঙ্গেলে। নিরাপদ দূরত্বে থাকা আমি আপনি কেউ কেউ গ্রহণ করছি সামাজিক বিচারের ন্যায়দণ্ড হাতে নিয়ে।

অন্যায়, ধর্ষণের অধিকার কারও নেই, কিন্তু তুমিই বা অত রাত করলে কেন মেয়ে! নিশ্চিন্তে ঘুমোতে যায় সমাজ।

তখনই প্রশ্ন জাগে, রেনেসাঁগর্বিত বাঙালি, আমরা আধুনিক হলাম না এখনও? মেরুকৃত আমরা, ইদানিংকালে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে (সঙ্গে সঙ্গে আট মাস বনাম চৌত্রিশ বছরের ব্যালান্সশিট খুলে বসে শতাংশের হিসেবে একে অপরের মুখোমুখি আমরা), অথবা সার্বিকভাবে নারী পুরুষ বিভাজনের ঊর্ধে উঠে সত্যকে বিচার করার মতো প্রতিস্পর্ধী অবস্থানে আসতে পারব না আমরা? বিচারপ্রত্যাশী এক নারী। হন্ডা সিটির পিছনের স্পেসের আয়তনের চুলচেরা বিশ্লেষণে মত্ত আমরা, একবারও কি মনে করব না, 'আদালত ও একটি মেয়ে' দেখে আমরাই হাততালি দিয়েছিলাম!

সেলুলয়েড থেকে নেমে এসে জানলায় দাঁড়িয়েছে বাস্তব। আমি কি এড়িয়ে থাকতে পারব?

ন্যায় পাক সমাজ। ন্যায় পাক নাগরিক। রাষ্ট্র এবং নাগরিকের মধ্যে দেয়-প্রাপ্যের যে ভারসাম্য আছে, তাতে ফাটল ধরলে কিন্তু বিপন্নতার সম্ভবনা। নাগরিকের অনাস্থায় রাষ্ট্র অচল, এই বোধ জাগ্রত হোক, কামনা শুধু এটুকুই।


অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

Tags:
.