রাজনীতিই সার: নিরাশায় মরে চাষা
কথাটা ছিল 'আশায় বাঁচে চাষা।' কৃষকের আর কিছুই নেই, শুধু আশাই সম্বল। পশ্চিমবঙ্গ সহ সারা দেশে কৃষক এখন সামনে আশারও কিছু দেখতে পাচ্ছেন না, দেনার দায়ে, হতাশায় আত্মঘাতী হচ্ছেন কৃষক।
কথাটা ছিল 'আশায় বাঁচে চাষা।' কৃষকের আর কিছুই নেই, শুধু আশাই সম্বল। পশ্চিমবঙ্গ সহ সারা দেশে কৃষক এখন সামনে আশারও কিছু দেখতে পাচ্ছেন না, দেনার দায়ে, হতাশায় আত্মঘাতী হচ্ছেন কৃষক।
এইটুকু বললেই অতি-রাজনীতির ব্যাধিতে ভয়ঙ্করভাবে আক্রান্ত এই রাজ্যে দু পক্ষের লাঠিসোঁটা বেরিয়ে পড়ে। সিপিআইএম না তৃণমূল কংগ্রেস- কে বেশি কৃষক দরদী, কাদের সর্বনাশা নীতির ফলে কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে? বামফ্রন্টের আমলে মোট কৃষক আত্মহত্যার সংখ্যাকে 34 দিয়ে ভাগ করে তারপর আবার 12 দিয়ে ভাগ করে তাকে আট দিয়ে গুণ করলে কত হয়? অর্থাৎ কৃষক আত্মহত্যার হার কাদের জনামায় কত বেশি?
কৃষক আত্মহত্যার পরিসংখ্যানে চিরকালই কিছু ভেজাল থাকে। সকলেই ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর প্রামাণ্য তথ্য উল্লেখ করেন। যেটা কেউই উল্লেখ করেন না, তা হল, ওই ব্যুরো আত্মহত্যাকারীর পেশার উল্লেখ করে মাত্র। অমুক ব্যক্তি আত্মঘাতী হয়েছেন এবং তিনি কৃষক ছিলেন- এটুকুই শুধু পাওয়া যায়। তিনি ঋণের দায়ে অথবা অন্য কোন কারণে আত্মহত্যা করেছেন, তা লেখা হয় না। মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ এবং অন্ধ্রপ্রদেশের তেলেঙ্গানা নিয়ে এ দেশে সবচেয়ে বেশি চর্চা হয়েছে। সেখান থেকে রিপোর্ট করার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকেই ভেজালের কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। নারীঘটিত সম্পর্কের কারণে আত্মঘাতীকেও দেনার দায়ে আত্মঘাতী বলে চালানের চেষ্টা চোখে পড়েছিল আমাদের।
তার মানে এই নয় যে ঋণগ্রস্ত কৃষক আত্মহত্যা করছেন না। বিভিন্ন রাজ্যেই করছেন, অনেক দিন ধরেই করছেন, বিপুল সংখ্যায় করছেন। মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্নাটকের পর এখন এই প্রবণতা পশ্চিমবঙ্গেও এসে পড়েছে। এখন মানে 2011 সালের 20 মে-র পর দিন থেকেও নয়। তার আগেও এ রাজ্যে ঋণগ্রস্ত কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। কৃষি একটি দীর্ঘমেয়াদী বিষয়। তাতে ভাল এবং মন্দ কোনওটাই মেশিনে ভোট গোণার মতো মুহূর্তের মধ্যে ঘটে না।
আসলে পশ্চিমবঙ্গ সহ সারা দেশে এবং ভারত সহ সারা বিশ্বেই কৃষি এখন গভীর সঙ্কটের মুখে। পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখে উত্পাদন বাড়ানো, বাণিজ্যিক ফসলের লাভের মুখে খাদ্য নিরাপত্তা বজায় রাখার মতো চ্যালেঞ্জ রযেছে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে অতি ক্ষুদ্র জোত এবং একরপ্রতি জমির উপর নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা বেশি হওয়ায় সমস্যা জটিলতর। এ রাজ্য সহ সারা দেশেই কৃষিতে সেচব্যবস্থার মতো দীর্ঘমেয়াদী পরিকাঠামো উন্নয়ন ঠিক মতো হয়নি, ক্রমাগত রাসায়নিক সারের ব্যবহারের জমির স্বাভাবিক উৎপাদিকা শক্তি কমে গিয়েছে। আলু, ধান, আখের মতো পণ্য চক্রাকারে একবার অতি উৎপাদন এবং একবার কম উৎপাদনের সমস্যায় ভোগে। দেশীয় কৃষি গবেষণার সুফল ক্ষেতে পৌঁছায় না, বীজ,কীটনাশকের কারবার একচেটিয়াভাবে বিদেশী বহুজাতিক সংস্থার হাতে চলে গিয়েছে।
এই অবস্থায় দলমত নির্বিশেষে সকলে সদ্ভাবনা নিয়ে একসঙ্গে সঙ্কটের মোকাবিলায় নামলেও কত দিনে সাফল্য আসবে বলা শক্ত।
তা না করে আমরা কে কয়টা কৃষকের লাশ দলীয় পতাকায় ঢাকতে পারলাম, অঙ্ক কষে কোন আমলে কৃষকের হাল বেশি খারাপ তার তরজায় নামলাম।
সুস্থ, শিক্ষিত, সদ্ভাবনা তাড়িত মানুষের লজ্জা হওয়া উচিত। আজকের পশ্চিমবঙ্গে আমাদের হয় না। আমরা অতি-রাজনীতির নেশায় দারুণ আরামের খোঁয়ারিতে আছি।
সুদীপ্ত সেনগুপ্ত