আদালত ও সরকার: অন্য রকমও হতে পারত
আদালত অন্যায়ের প্রতিকার যদি করে তবে সে তো খুবই ভাল কথা। তার জন্যই তো বিচারব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু আরও ভাল হত যদি অন্যায়টা আদৌ সংঘটিতই না হত। সেটাই কি একটি জনপ্রিয় সরকারের কাজ নয়?
বিপুল জনাদেশ নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে জোট সরকার। যেমন 2006 সালে বিপুল জনসমর্থন পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকার। এমনভাবে জিতলে বিরোধীদের কথা শোনার ইচ্ছা হয় না, দরকারও থাকে না। মনেও থাকে না যে প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রে প্রায়শই বিরোধীদের কণ্ঠে সাধারণ মানুষের স্বরই প্রতিধ্বনিত হয়। বুদ্ধদেববাবুর কথাটা মনে ছিল না, যখন বলেছিলেন, 'আমরা 235, ওরা 30, দেখি কে আমাদের আটকায়?' মমতাদেবীরও কথাটা মনে নেই বোঝা যায় যখন তিনি বলেন, 'এখন 10 বছর ওরা চুপ করে মুখ বন্ধ করে থাকুক।'
এই রকম অবস্থায় সরকারের কাজকর্মের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য স্বরটা অনেক সময়েই অতি মৃদু বা এমনকি অনুপস্থিত থাকে। সরকারও স্বাধিকারপ্রমত্ত হস্তীর মতো বিচরণ করতে থাকে। যত ক্ষণ না তার রাশ টেনে ধরে গণতন্ত্রের আর কোনও স্তম্ভ। রাজ্য সরকারের ক্ষেত্রে এখন বারবার যে কাজটা করছে আদালত।
সংগ্রামপুর বিষ মদ কাণ্ডে নিহতদের ক্ষতিপূরণ দান স্থগিত রাখতে হল হাইকোর্টের নির্দেশে। বিষ পানে কেউ মারা গেলে সরকার (আসলে আমজনতা) তার ক্ষতিপূরণ দেবে কেন, এটাই যথেষ্ট যৌক্তিক প্রশ্ন। তার উপর সেই বিষাক্ত মদ তৈরি, বিক্রি, ক্রয় এবং পান যখন বেআইনি, তখন প্রশ্নটি আরও গুরুতর। বিষমদে নিহতদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্ত ঘোষণার পরই শোনা যাচ্ছিল, তবে কি রাজ্য সরকার বেআইনি মদ খাওয়ার জন্য প্রিমিয়ামবিহীন বিমার ব্যবস্থা করে দিল? সরকার কথাটা ভাবেনি। ভাবতে বাধ্য করল আদালত।
লোকসানে চলা রাষ্ট্রায়ত্ত পরিবহণ সংস্থাগুলির আর্থিক দায় নেবে না বলে সরকার কর্মীদের বেতন, পেনশন বন্ধ করে দিয়েছিল। হাইকোর্ট প্রথমে বলল, কোম্পানির অবসরপ্রাপ্ত সাধারণ কর্মীদের পেনশনের টাকা না থাকলে তার চেয়ারম্যান, ম্যানেজিং ডিরেক্টর ইত্যাদি বড় কর্তাদের প্রাপ্য কেটে পেনশন দেওয়া হোক। কর্তারা প্রতিবাদে হাইকোর্টে গেলেন। শেষে আদালত বলল, পেনশন দিতেই হবে। সাধারণভাবে সাধারণ মানুষেরও মনে হচ্ছিল, সামান্য দু তিন হাজার টাকা পেনশন পান যে মানুষটা, সারা জীবন কাজ করে এসেছেন সরকারি সংস্থায়, চিরকাল জেনে এসেছেন, পেনশন পাবেন রিটায়ার করার পর, তাঁর পেনশন বন্ধ করাটা ঠিক নয়। সরকার ভেবেছিল, ওই কর্মীরা বাম আমলে রাজনৈতিক দাক্ষিণ্যের কারণে অন্যায়ভাবে নিযুক্ত, তাই আর্থিক সমস্যার কারণে তাঁদের পেনশন ইত্যাদি আটকানোটা খুব অন্যায় হবে না। সরকারের ভাবনা ঠিক ছিল না। আদালত স্মরণ করিয়ে দিল।
কলেজে ছাত্র সংসদের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রায়গঞ্জ সহ রাজ্যের আর পাঁচটা জায়গায় যেমন নিন্দনীয় শিক্ষক নিগ্রহের ঘটনা ঘটেছিল, মাজদিয়াতেও ঠিক তাই হয়েছিল। সব কয়টি ঘটনাই সমান খারাপ এবং রাজ্যের কলেজ শিক্ষা সম্বন্ধে সমান লজ্জাজনক কাহিনী বলে। মাজদিয়ায় শুধু ব্যতিক্রম বলতে এটাই ছিল যে অভিযুক্তরা এসএফআই সমর্থক। তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা এমনভাবে সাজাল পুলিশ, যে অন্য সব ঘটনায় পরদিনই নিম্ন আদালতে অভিযুক্তরা জামিন পেলেও মাজদিয়ায় তাঁরা পেলেন না। সাধারণ মানুষ এর মধ্যে বৈষম্য দেখছিলেন। হাইকোর্ট নিঃশর্তে মাজদিয়ার অভিযুক্তদের জামিন দিয়ে প্রমাণ করেছে সাধারণ মানুষের ভাবনা ভুল ছিল না।
হাইকোর্ট হস্তক্ষেপ করছে সরকারের সন্দেহজনক অতি সক্রিয়তার ক্ষেত্রেও। পুলিশের সংগঠন বা ইউনিয়ন করার অধিকার থাকা উচিত কি না- এ বিষয়ে কোনও সর্বজনমান্য মত নেই। বর্তমান সরকারের মত, থাকা উচিত নয়। পূর্বতন সরকারের মত ছিল, থাকা উচিত। এই বহুত্ব ভারতের রাষ্ট্রব্যবস্থা মেনে নেয়। যা মানে না, তা হল সরকারি নির্দেশিকা জারির পরই দুটি সংগঠনের মধ্যে একটিকে বেছে নিয়ে শুধু বামপন্থী সংগঠনের ঘরগুলি ভাঙতে শুরু করা। স্বাভাবিকভাবেই হাইকোর্টে যাওয়ামাত্র স্থগিতাদেশ পেয়ে গিয়েছে সংগঠনটি।
আদালত অন্যায়ের প্রতিকার যদি করে তবে সে তো খুবই ভাল কথা। তার জন্যই তো বিচারব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু আরও ভাল হত যদি অন্যায়টা আদৌ সংঘটিতই না হত। সেটাই কি একটি জনপ্রিয় সরকারের কাজ নয়?
সুদীপ্ত সেনগুপ্ত