তিনি মরিয়া প্রমাণ করিলেন যে তিনি মরেন নাই

ইন্টারভিউ নেওয়ার ডেট ঠিকঠাক. নিজে ফোন করে কনফার্ম করেছেন. অতএব ক্যামেরা, লাইটস বুক করা হয়ে গেছে. আগের দিন মাঝরাতে হঠাত্ ফোন, “কাল পারব না গো, ফুলকলি!”

Updated By: Jan 21, 2014, 12:06 AM IST

ইন্টারভিউ নেওয়ার ডেট ঠিকঠাক. নিজে ফোন করে কনফার্ম করেছেন. অতএব ক্যামেরা, লাইটস বুক করা হয়ে গেছে. আগের দিন মাঝরাতে হঠাত্ ফোন, “কাল পারব না গো, ফুলকলি!”

“কেন গো...” মনে ভাবলাম, এত পরিশ্রমের পর এই!

“কাল খবরেই জানতে পারবে. সত্যিই কারণ আছে বলে পারছি না. জানুয়ারির মাঝবরাবর তোমাকে টাইম দিয়ে দেব.”

“এত দিন! আর একটু আগে করলে হয় না গো!”

“মা অসুস্থ. বাট শোনো, ইট ইজ ভেরি পার্সোনাল. একটু সামলে নিয়ে তোমাকে ফোন করছি..”

দিন দুয়েকের মধ্যেই ছবিটা আরও মেঘে ঢেকে গেল. মহানায়িকা ভর্তি হলেন হাসপাতালে. সাংবাদিকমহলে সহসা একটা ঝড় বয়ে গেল.

ব্যাপার বুঝে আমি মেসেজ করলাম. দিদি, আমি অনেক দূরের মানুষ. তবু যদি একটুও হেল্প লাগে বলবেন. উত্তর এল, নিশ্চয়ই. তুমি যে বললে, এটাই ভাল লাগল.

ডিসেম্বরের শেষ হপ্তা থেকে অপেক্ষা আর তোড়জোড়. ক্যামেরা-বুম নিয়ে ঘণ্টায় ঘন্টায় আপডেট. সাংবাদিকতার নয়া সিলেবাসে একটা নতুন পয়েন্ট অ্যাড করা দরকার ছিল. জ্যোতিষচর্চা আর টিয়াপাখি... সরি ট্যারট রিডিং. ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় আজকালকার দিনে যা ঘটছে সেটা খবর নয়, যা ঘটবে সেটার আগাম “লাইভ” করাটাই খবর! একটু হরোস্কোপ চর্চা না করলে এই বাজারে এঁটে ওঠা শক্ত. যাই হোক. মহানায়িকা বেল ভিউ-তে. তিন দশক অন্তরীণ থাকার পর এই প্রথম বিষম প্রাণসংশয়. এদিকে আমাদের ঘরে যমদূত এই আসেন কি এই যান.. অমনি সেই সাংবাদিকরা, যাঁরা এত দিন টুকি দিয়েও দেখতে পাননি বয়সের ভারে কুঞ্চিত চিরযৌবনার মুখ, তাঁরা প্রতিদিন হত্যে দিয়ে পড়ে থাকতে শুরু করলেন. শেষবেলায় যদি এক্সক্লুসিভটা পাওয়া যায়..

এটাই যে শেষবার, সেটাই বা বুঝলেন কি করে? এখানেই সাংবাদিকে-মহানায়িকায় টানাটানি শুরু হল. আমার সতীর্থদের সঙ্গে আলোচনাক্রমে বুঝলাম, সবারই “নিজেদের লোক” ফিট করা আছে. যাঁকে কেউ চোখে দোখেননি জন্মাবধি, তাঁরাও এই নিজেদের লোক-এর মারফতই মহানায়িকাকে চাক্ষুষ করতে শুরু করলেন. দুর্ভাগ্যের বিষয় এটাই, এতগুলো “নিজেদের লোক”-এর কেউই স্যাট করে একটা মোবাইলে ছবি তুলতে পারলেন না. নিদেনপক্ষে একচিলতে ভিডিয়ো যা প্লাটিনামে গড়া প্রাসাদের চাইতেও মূল্যবান হতে পারত যে-কোনও চ্যানেলের কাছে, কেউই তেমন কিছু দিতে পারলেন না. তাই বাধ্য হয়ে স্ক্রোলারে চলতে থাকল মেডিক্যাল বুলেটিনের খবর. কখনও তিনি স্থিতিশীল, কিন্তু সংকটমুক্ত নন. কখনও তিনি স্থিতিশীল, কিন্তু গভীর সংকটে. কখনও চিকিত্সায় সাড়া দিচ্ছেন না, কিন্তু স্থিতিশীল...এইরকম সব পারমুটেশন কম্বিনেশন. আইসিইউ থেকে যখন আইটিইউ তে ট্রান্সফার করা হল তাঁকে. তখন থেকেই উড়ো খবর. অ্যালার্ট থেকো, খবর মিস যেন না হয়. যাঁরা জয়েন্টে মেডিক্যালে পাঁচবার দিয়েও পাননি, এবং আর তিনবার চান্স দিলেও পেতেন না, তাঁরাও মুখস্থ করে ফেললেন মেডিক্যাল পরিভাষায় নল কী এবং কয় প্রকার... হৃদয়ের চেয়েও ফুসফুস কত জরুরি ইত্যাদি ইত্যাদি...এন্ডোট্রাকিয়াল টিউব, রাইলস টিউব, স্যালাইন টিউব ইত্যাদি ইত্যাদি. সপ্তপদী, হারানো সুর, দীপ জ্বেলে যাই ছেড়ে সবাই ফুসফুস নিয়ে চর্চা, আলোচনা ও বক্তব্য পেশ করতে শুরু করলেন. বসের চোখ-রাঙানি সত্ত্বেও সেলিব্রিটি বাইট পাওয়া দুষ্কর হল. “কিছু একটা” কনফার্ম না হওয়া পর্যন্ত কেউই মুখ খুলতে চাইলেন না.

আমিও খবর পেলাম, শনিবার সকাল থেকে সাড়া মিলছে না.. আধুমিকতম কোনও চিকিত্সাতেই. এই অবস্থাকে ক্লিনিক্যালি ডেড বলা চলে. আমারই নিজের লোক জানাল, “পিসি, শুধু সময়ের অপেক্ষা. ডাক্তারবাবু এন্ডোট্রাকিয়াল টিউব গুলো খুলে নিলেই...”

এদিকে কাগজগুলোয় ফি-দিন মহানায়িকার ফ্লায়ার. কখন ব্রেকফাস্ট করলেন, কখন একটু ঠাট্টাতামাশা করলেন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সে সবের ফিরিস্তি হচ্ছে. দিল্লির নির্বাচন, আপ, দুবার ধর্যিতার মৃত্যু সব ছাড়িয়ে প্রতি ঘণ্টায় মহানায়িকা বুলেটিন. আশঙ্কা আর অপেক্ষার বেলুন ফুলতে ফুলতে এমন চেহারা নিল যে মৃত্যুর খবরটা এমন ভীষণ শব্দে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে যা কিনা টেরর অ্যাটাকের চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর. সাংবাদিকেরা সবাই ছুটি-টুটি ক্যানসেল করে সেই ভয়ঙ্কর শেষের সেদিনের জন্য বসে রইলেন. মহানায়িকা সম্পূর্ণ নিরুত্তর হলে তাঁরা কী কী কথা বলবেন, তার আগাম শব্দছক তৈরি করতে থাকলেন. জিইসি গুলো সুযোগ পেয়ে সাদা-কালো হয়ে গেল. মহানায়িকাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে আরম্ভ করল.

বেলুন ফুলতেই থাকল, কিছুই হল না. সারা হপ্তা পাপস্খলন করে রবিবার লাঞ্চ সেরে একটু স্থিতিশীল হবো ঠিক করেছি, অমনি মোবাইলের ওপার থেকে সঙ্কেত এল- “গেস্ট ভাব, গেস্ট ভাব!”

এসব ভাবনা মনে-মনে ভাবা যায় না, ফোনে-ফোনে ভাবতে হয়. ফোন করলাম মহানায়িকারই এক সতীর্থকে. তাঁরও উত্সুক প্রশ্ন, উনি কী এখনও ইহলোকে আছেন? মুখ্যমন্ত্রী বার বার গেলেন, মনে হয় আর... কী বলিস? আমি তো শুনলুম দাহ হয়ে যাবে. বডি ওরা বার করবে না ঠিক করেছে.. কী বলিস? আরে বাবা, বল না, খবর তো তোদের কাছেই পাওয়া যায়..” পরেরজনকে ডায়াল করলাম. “আমি তো জামশেদপুরে. আজ হলে তো পারব না রে. কিন্তু ওঁর ব্যাপারটা এখন কী হল বলতো. এত বয়সে এই ধকল নিতে কী আর পারবেন?” তবুও মন্দের ভাল, পাওয়া গেল দুজনকে. তবে, এখনও অন্তিম খবরটা আসেনি.. না আসা অবধি অপেক্ষা. এলেই এঁদের জন্য রেড অ্যালার্ট জারি..

কাদম্বরী মরিয়া প্রমাণ করিয়াছিল যে সে মরে নাই. ইনি না মরিয়া সকল স্বভাবকৌতূহলী, গুজবসন্ধানী, লোভীদের কপোলে সজোরে চপেটাঘাত করিলেন. আগামী শনিবারের আগাম খবর, মহানায়িকা বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন. বোরডম কাটাতে মিউজিক থেরাপিও আর তাঁর ভাল লাগছে না. মন চলো নিজ নিকেতনে...

ঠিকমতো জ্যোতিষশাস্ত্র না-জানার জন্য এবারও হেরে গেলেন সাংবাদিকরা. সিলেবাসে এতদিন ছিল না.

তাঁর স্বেচ্ছানির্বাসন ধ্বংস করার লোভ সামলানো কী এতটাই অসম্ভব ছিল? যে-সংযমে তিনি কোনও লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্টের ধাতব ফলক নেননি, ছবি তোলা হবে বলেই প্রত্যাখ্যান করেছেন দাদাসাহেব ফালকের মতো গৌরব, সেই সংযমের প্রতি এতটুকুও সম্ভ্রম রইল না কেন? স্বেচ্ছানির্বাচনের মতো তাঁর একটি নির্বিঘ্ন ইচ্ছামৃত্যুকেও কেন মেনে নেওয়া হবে না?

নাঃ, এখানেও ভাবনার ভেলা থামানো গেল না. প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে মৃত্যু একদিন এলই শিয়রে. সহসা হুলস্থূল, হুড়োহুড়িতে কেটেও গেল সারাদিন. যথাসম্ভব ঘেরাটোপে রক্ষা করা হল মহানায়িকার চির অন্তরাল. শেষ ইচ্ছে মেনে, চন্দনচিতায় দাহ করা হল তাঁর নশ্বর দেহ. ধোঁয়ার কুণ্ডলী, চোখভরা জল তখনও ঝাপসা করে দিল ক্যামেরার কাঁচ. স্বর্গোদ্যানে চলে গেলেন মহানায়িকা. খুব কাছে যাঁরা ছিলেন, মুখাগ্নির সময়ে কফিনের ঢাকনা সরানো হলে...

মহানায়িকা উপাখ্যান এখানেই শেষ. যতটা চেয়েছিলেন তিনি, ততখানি স্বেচ্ছাগোপনের সুযোগ তাঁকে দেওয়া হল কই? শেষবেলায় যাঁরা কয়েক মুহূর্ত দেখে জীবন সার্থক করলেন, তাঁরাও কী পারলেন আসলে তাঁর শেষ ইচ্ছেটুকুর মর্যাদা দিতে?

যাঁরা দশকের পর দশক ধরে বাংলা ছবিকে শুধু দিয়েই গিয়েছেন, তাঁদের কী হবে? যখন প্রতিদানের সুযোগ এসেছে তখন সাংবাদিকেরা আশ্চর্যরকম নীরব থেকে গিয়েছেন. সত্তর বছরেরও বেশি সময় জুড়ে ভারতীয় ছবিতে অভিনয় করেছিলেন এক অসাধারণ সুন্দরী অভিনেত্রী. উপষুক্ত রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষণ না থাকায়, তাঁর মৃতদেহে মাল্যদান করবার লোকই পাওয়া যায়নি!! খুঁজে দেখুন, এমন আরও অনেক ব্যক্তিত্ব কোনও না কোনও অখ্যাত হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা কষছেন. সেই সব মানুষকে হাইলাইট করলে হয় না?

শেষ হয়েও নয় শেষ:

পাঁচ বছরের এক পুঁচকে শীতের সকালে ঘুম থেকে উঠে মাকে জানাল, মা, আজকে আমার কেমন যেন স্থিতিশীল-স্থিতিশীল লাগছে. আজ স্কুলে যাব না..

ফুলকলি

Tags:
.