পর্দার নেগি এখন দিলওয়ালে আর বাস্তবের নেগি আক্ষেপের দুনিয়ায়
স্বরূপ দত্ত
মেরি কম বায়োপিক তৈরি হয়েছে। মিলখা সিংকে নিয়ে ভাগ মিলখা ভাগ ফিল্ম তৈরি হয়েছে। মহেন্দ্র সিং ধোনি থেকে মহম্মদ আজাহারউদ্দিনেরও বায়োপিক তৈরি হচ্ছে। কিন্তু তাঁর নামে কোনও বায়োপিক তৈরি হয়নি। তিনি মীর রঞ্জন নেগি। সেই হকি খেলোয়াড় এবং কোচ। যাঁর চরিত্র নিয়ে তৈরি হয়েছিল ফিল্ম, যা বক্স অফিস মাত করে দেয়। কবীর খান তো কেউ ছিলেন না। বাস্তবে ছিলেন মীর রঞ্জন নেগি। তাঁর চরিত্রে অভিনয় করেই শাহরুখ খান চক দে ইন্ডিয়ার মাধ্যমে, দেশের হকিকে ফের নিয়ে এসেছিলেন ফ্ল্যাশবাল্বের ঝলকানির সামনে। কিন্তু দেখতে দেখতে কেটে গিয়েছে বেশ কয়েকটা বছর। হেট স্টোরি থ্রি, জিসম থ্রি, ধুম থ্রি-ও বেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাতকারণে দেখা নেই চক দে ইন্ডিয়া টু-র! হতাশ বাস্তবের কবীর খান। চক দে ইন্ডিয়া থেকে আদেশ শ্রীবাস্তবের হঠাত্ প্রয়াণ কিংবা শাহরুখ খানের একবারও ফোন না করা নিয়ে মুম্বই থেকেই ২৪ ঘণ্টা ডট কমকে, মীর রঞ্জন নেগি দিলেন এক্সক্লুসিভ সাক্ষাত্কার।
প্রশ্ন : কী করছেন এখন? শুনলাম, একটা হকি দল বানিয়েছেন নিজেই। সেটা কি ছেলেদের দল নাকি মেয়েদের?
মীর রঞ্জন নেগি : চক দে ইন্ডিয়া মুক্তি পাওয়ার পর আমি একটা ফাউন্ডেশন তৈরি করেছি। এটা আমার ১৯ বছরের ছেলে অভি রঞ্জনের স্মৃতির উদ্দেশ্যে। মাত্র ১৯ বছর বয়সেই ছেলেটা আমার মোটরবাইক দুর্ঘটনায় মারা গেল! তাই ওর স্মৃতির উদ্দেশ্যেই ফাউন্ডেশনটা বানিয়েছি। আমাদের এখানে প্রায় ৪০০ বাচ্চা হয় হকি, না হয় ফুটবল কিংবা অ্যাথলেটিক্স শিখছে। গতবছরই সিনিয়র ডিভিশনের ফাইনালে খেলেছে আমাদের দল। এবার তো ফল আরও ভালো। এয়ার ইন্ডিয়া, পাঞ্জাব অ্যান্ড সিন্ধ ব্যাঙ্ক, ওয়েস্টার্ন রেলওয়েজের মতো বড় দলগুলোর সঙ্গে আমাদের ছেলেরা দিব্যি কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে খেলেছে। আমাদের অ্যাকাডেমির একটি ছেলে তো সম্প্রতি জুনিয়র ইন্ডিয়াতেও খেলেছে। সে-ও আমার মতো গোলকিপার। নাম, সুরজ কেরকেরা।
প্রশ্ন : এখন সিক্যুয়েল বানানোটা বলিউডের একটা ট্রেন্ড। সব ফিল্মেরই টু, থ্রি বা ফোর বেরোচ্ছে। কিন্তু চক দে ইন্ডিয়া বক্স অফিসে অত ভালো সাফল্য পাওয়ার পরও কেন সিক্যুয়েল তৈরি হল না?
মীর রঞ্জন নেগি : আপনি প্রশ্ন করছেন। আমি নিজেই তো অবাক হই এটা নিয়ে। ভাবি যে, ধুম টু, থ্রি, ফোর , আরও কত বেরোবে কে জানে! আরও কত কত ফিল্মেরই তো স্যিকুয়েল তৈরি হচ্ছে। সেখানে যশরাজ ফিল্মস কি চক দে ইন্ডিয়া টু বানাতে পারত না! এমন নয়, আমার গল্প দিয়েই বানাতে হবে। আরও কত হকি খেলোয়াড় রয়েছে। তাঁদের গল্প তুলে ধরলেই হতো। আমাদের দেশের মানুষ হকি পছন্দ করে। সে তো চক দে ইন্ডিয়ার বক্স অফিস সাফল্যই প্রমাণ করে।
প্রশ্ন : শাহরুখ খানের সঙ্গে একটা সময় আপনার রোজ অনেকবার করে কথা হতো। এখন সম্পর্কটা কেমন? আর আগের মতো দেখা বা কথা হয় টয়?
মীর রঞ্জন নেগি : দেখুন শাহরুখ খান, সলমন খান বলিউডে রাজ করেন। তারমধ্যেও চক দে ইন্ডিয়া তৈরি হওয়ার সময়, আমার সঙ্গে প্রায় দেড় বছর এসআরকের দারুণ ঘনিষ্ঠতা ছিল। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী এখন আর সেই সম্পর্কটা বজায় নেই। শাহরুখ ব্যস্ত মানুষ। তাই আর ফোন করে না।
প্রশ্ন : সুরকার আদেশ শ্রীবাস্তব অল্প বয়সে চলে গেলেন। আপনার তো খুব কাছের বন্ধু ছিল। কেন হল এমন?
মীর রঞ্জন নেগি : আদেশ আমার খুব ভালো বন্ধু। মানুষ হিসেবেই ও খুব ভাল ছিল। অমিতাভ বচ্চনের কত গানের সুর করেছে ও। যখন জব্বলপুর থেকে মুম্বইতে এসেছিল, তখন থেকেই আমার সঙ্গে সম্পর্ক। গতবছরও ওর জন্মদিনে হাজির ছিলাম। সেখানে অমিতাভ বচ্চনও উপস্থিত ছিল। ঋষি কাপুর থেকে শুরু করে, হাজির ছিল বলিউডের একঝাঁক সেলিব্রেটি। ওর স্ত্রী বিজয়তা পণ্ডিতের সঙ্গেও আমার সম্পর্কটা ভালো। কিন্তু রক্তে ক্যান্সার ধরা পড়ল। যে দিন হাসপাতেল মারা গেল, সেদিন এসআরকে থেকে সোনু নিগম সবাই উপস্থিত ছিল। শাহরুখ ওর হাতটা প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে বলেছিল, কিছু হবে না। সবঠিক হয়ে যাবে আদেশ। কিন্তু কিচ্ছু ঠিক হল না আর।
প্রশ্ন : উত্তরাখণ্ডে তো একটা ফিল্মে সম্প্রতি অভিনয়ও করলেন। কেমন চলল?
মীর রঞ্জন নেগি : হ্যাঁ, 'সবেরু ঘম' নামে সম্প্রতি একটি ফিল্মে অভিনয় করেছি। রিলিজও হয়েছে। গত ২০ বছরে অন্যতম হিট ফিল্ম নির্বাচিত হয়েছে। উত্তরাখণ্ড তো বটেই, দিল্লি এবং মুম্বইতেও মুক্তি পেয়েছে ফিল্মটি। আমি ওই ফিল্মে এক ডাক্তারের চরিত্রে অভিনয় করেছি। লোকে ফিল্মের পাশাপাশি আমার অভিনয়েরও খুব প্রশংসা করেছেন।
প্রশ্ন : আজ মেরি কম, মহম্মদ আজাহারউদ্দিন, মহেন্দ্র সিং ধোনির উপরও বায়োপিক তৈরি হচ্ছে। আপনার বাস্তব জীবনের গল্পের উপরেও চক দে ইন্ডিয়া তৈরি হয়েছে। কিন্তু ফিল্মের নাম আপনার নামে নয়! আফশোস আছে নাকি কোনও?
মীর রঞ্জন নেগি : প্রচুর মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি চক দে ইন্ডিয়া মুক্তি পাওয়ার পর থেকে। হকি খেলেও অত ভালোবাসা পাইনি। কলকাতায় যখন গিয়েছি, ওখানকার মানুষরাও আমাকে প্রচুর ভালোবাসা দিয়েছে। না, আফশোস আছে, সে কথা বলব না।
প্রশ্ন : আসছে দিনগুলোতে কিসে বেশি সময় দেবেন? অভিনয়ে নাকি হকিতে?
মীর রঞ্জন নেগি : আসলে আমি একজন হকি খেলোয়াড় আর কোচ। নতুন প্রজন্মের হকি তারকা যুবরাজ বাল্মিকী এখন রিয়েলিটি শো করছে। খতরো কি খিলাড়িতে ওকে দেখে দারুণ লাগলো। হকি কর্তাদের উচিত, যুবরাজের এই ক্যারিশমাটা হকি মাঠেও কাজে লাগানো। আমিও বাচ্চাগুলোর সঙ্গে হকি মাঠেই বেশি সময় দেব। আর একটু সময় হাতে থাকলে অবশ্যই গলফ কোর্সে দেব। গলফে কিন্তু আমি খুব ভালো কিছু প্রস্তাব পেয়েছি। সেগুলো পরে সবাইকে জানাবো।
প্রশ্ন : ভারতীয় হকি নিয়ে কী বলবেন এখন?
মীর রঞ্জন নেগি : অনেক কিছুতে সমস্যা রয়েছে। প্রায়ই কোচ বদল। বিদেশি কোচ আসছে, যাচ্ছে। অথচ, ভারতীয় হকির কোনও উন্নতির লক্ষ্য নেই। আমার মনে হয় না, অন্য কোনও দেশ হকির জন্য এত টাকা আর এত সময় খরচ করে বলে। হকি কর্তাদের এবার নতুন কিছু ভাবতে হবে। ভালো খেলোয়াড়দের আরও একটু বেশি সম্মান দেওয়া উচিত। যেমনটা দেশের ক্রিকেট দল নির্বাচনের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। সবাইকে এক সারিতে বসিয়ে দিলে সমস্যা তো আসবেই। সবমিলিয়ে এখন দেশের হকি পরিস্থিতি নিয়ে আমি খুব একটা আশাবাদী নই।
প্রশ্ন : চক দে ইন্ডিয়ার পর আপনাকে কখনও দেশের পুরুষ হকি দলের কোচের দায়িত্ব নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল? আপনি দায়িত্ব পেলে কি দেশের পারফরম্যান্স বদলাতো?
মীর রঞ্জন নেগি : আমায় হকি কর্তারা কেন যে পছন্দ করে না, সে কথা ওঁরাই বলতে পারবেন। ৩২ বছর পর আমি আর কৌশিক, সোনার পদক এনে দিয়েছিলাম দেশকে। কিন্তু জানি না, কী কারণে, দুজনকেই সরিয়ে দেওয়া হল। দেশের দায়িত্ব দেওয়ার কথা বলছেন, হকি ইন্ডিয়া লিগেও আমাদের অনেককে কাজে লাগানো হয় না। এর মানে এই না যে, আমার চাকরি নেই। আমি ভালোই চাকরি করি। কিন্তু সবসময় মন চায় দেশের হকির জন্য কিছু করার। কিন্তু ওঁদের যে সুযোগটাই দেওয়ার ইচ্ছে নেই।
প্রশ্ন : কখনও রাজনীতিতে নামার কথা ভেবেছেন?
মীর রঞ্জন নেগি : অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বর সঙ্গে মিশেছি। ভালো সময় কাটিয়েছি। দরজা খোলা রয়েছে। কখনও তেমন কিছু হলে তো খবর পাবেনই।
প্রশ্ন : ৮ বছর পর কী মনে হয়, চক দে ইন্ডিয়ার পর মীর রঞ্জন নেগির জীবন ঠিক কতটা প্রভাবিত করল?
মীর রঞ্জন নেগি : মানুষের জীবন সত্যিই বদলে য়ায় এক লহমায়। আসরানিজিকেই দেখুন না। কত কত ফিল্মে অভিনয় করেছেন। কিন্তু শোলের সেই আংরেজো কে জামানে কে জেলরের জন্যই তো মানুষ তাঁকে চিরকাল মনে রেখে দেবে। আমি ইতিবাচক মানুষ। ভাবতে ভালো লাগে চক দে ইন্ডিয়া নামের ফিল্মটি আমার জীবনের প্রেরণায় বানানো হয়েছিল। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মনে থাকবে এটাই। নিশ্চয়ই গর্বিত হব, শেষদিন পর্যন্ত।