বড় জ্যান্ত ছিল রতন দা...
কুশল মিশ্র
রতন দার মতো জ্যান্ত লোক আমি খুব কম দেখেছি। অজস্র কথা, অনেক স্মৃতি....। সব বলে শেষ করা যাবে না। তখন সবে সাংবাদিকতার হাতেখড়ি। খোঁজখবর বলে একটি জনপ্রিয় অনুষ্ঠানে কাজ করি। সেখানেই প্রথম দেখি চওড়া গোঁফওলা অসম্ভব জ্যান্ত মানুষটিকে। খবরের জন্য অক্লান্ত...
খোঁজখবরের অফিসটা বলতে গেলে এককথায় রতন দার বাড়ি ছিল। ওখানেই দিনের পর দিন রাতের পর রাত। খবর সংগ্রহে বেরনো রিপোর্টাররা বলত রতন দার হাতে স্টিয়ারিং মানে নিশ্চিন্ত। ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় পৌছে যাবে গাড়ি। স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতেই খবরের জগতের মধ্যে সংসার ফেঁদে নিয়েছিল রতন দা।
সারাদিন খাওয়া নেই। ১৬ ঘণ্টা স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে রতনদা অফিসে ফিরেছে। চোখেমুখে জল দিয়েই একঝটকায় চাঙ্গা। আবার ইয়ার্কি, খবর তুলতে গিয়ে কোন কোন বিপদের মুখে পড়তে হয়েছে, তার ডিটেল রিপোর্টিং। রতন দার কথা শুনতে শুনতে কেটে যেত সময়। এরপর রতন দা রাতের অফিস স্টাফেদের জন্য খিচুড়ি বসাবে। সেই খিচুড়ি খেয়েই আমরা মধ্যরাতের স্বাধীনতা উদযাপন করব।
রতন দার মিমিক্রি করার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। অবলীলায় অফিসের বস থেকে রিপোর্টার, কপি করে নামিয়ে দিতে রতন দার জুড়ি মেলা ভার। আমরা খবরের কপি লিখতাম...রতন দা জীবনকে কপি করে ফেলত অনায়াসে।
মর্নিং পিক আপে বেশ কয়েকবার রতন দা গেছে আমাকে তুলতে। সেও এক অভিজ্ঞতা। অনর্গল কথা...বকবকে ভরে থাকত গোটা রাস্তা।
খবরেই জীবন ঢেলেছিল রতন দা। ব্যক্তিগত জীবনে বিপর্যয় ছিল অসংখ্য। বুকের ভেতরে ছিল অজস্র যন্ত্রণা।
রতন দার ময়লা জামায় বঞ্চনা, যন্ত্রণার এমন অনেক ধুলোই জমা পড়েছে। সাধক ঋষির মতো সেসব ফুতকারে উড়িয়ে দেবার অসামান্য দক্ষতা ছিল কাজ পাগল মানুষটার।
চব্বিশ ঘণ্টায় আবার দেখা হল বহু বছর পর। সেই একইরকম। প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা, অক্লান্ত।
আবার ক্যান্টিনে পিকনিক। রান্না...সেই পুরনো ফর্মে রতন দা।
শেষ সময়েও শুনেছি ফেরার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছিল চওড়া গোঁফের মানুষটা... যন্ত্রণায় বেঁকে গেছে শরীর... বিস্ফারিত চোখ... আমার মনে হয় রতন দা এই অসময়ে যেতে চায়নি.. অ্যাসাইনমেন্ট শেষ না করে রতন দা কখনও ফেরেনি... কিন্তু এ বার আর পারল না...যন্ত্রণায় মুচড়ে ওঠা শরীরটা থেকে তখন সাইন অফে বেরিয়ে আসছে, দেরী হয়ে যাচ্ছে...আমায় যাদবপুর যেতে হবে...যাদবপুর।