Tabla Maestro Pt Swapan Chaudhuri: পণ্ডিত স্বপন চৌধুরী এখন 'রত্ন'! কেন এই তবলাশিল্পীকে নিয়ে বাঙালির উল্লসিত হওয়া উচিত...
Tabla Maestro Pt Swapan Chaudhuri: স্বপন চৌধুরীর আগে মাত্র ১৬ জন বাঙালি এই বিরল সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। শেষবারের মতো বাঙালির কপালে এই পুরস্কার জুটেছিল ১৪ বছর আগে। তা-ও কি বাঙালি স্বপন চৌধুরীকে নিয়ে হইচই করবে না? বাঙালির কি আত্মসম্মান, আত্মমর্যাদা, আত্মশ্লাঘা কম পড়িল? কম পড়িয়াছে তার জাত্যভিমানে?
সৌমিত্র সেন: সম্প্রতি এক বিরল সম্মানে ভূষিত হয়েছেন তবলাবাদক পণ্ডিত স্বপন চৌধুরী! তিনি সংগীত নাটক একাডেমির 'ফেলো' নির্বাচিত হয়েছেন। যে কোনও কারণেই হোক বাঙালির দৈনন্দিনে এ নিয়ে প্রাথমিক ভাবে তেমন আলোড়ন দেখা যায়নি।
এবছর সংগীত নাটক একাডেমি ২০১৯, ২০২০ এবং ২০২১ সালের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেছে। দেশ জুড়ে মোট ১২৮ জন শিল্পী সম্মানিত হয়েছেন। কিন্তু ফেলোশিপ পেয়েছেন সারা দেশে মাত্র ১০ জন। তাঁদেরই একজন দু'বারের গ্র্যামি নমিনেশন পাওয়া বাঙালির গৌরব অনন্য তবলাশিল্পী কিংবদন্তি পণ্ডিত স্বপন চৌধুরী। পণ্ডিত স্বপন চৌধুরী ছাড়া আর যাঁরা এই ফেলোশিপ এ বছর পেয়েছেন তাঁরা হলেন-- ভারতনাট্যম নৃত্যশিল্পী সরোজা বৈদ্যনাথন, কথাকলিশিল্পী সদানম কৃষ্ণণ কুট্টি, মণিপুরী নৃত্যশিল্পী দর্শনা ঝাভেরি, ধ্রুপদী কণ্ঠসংগীত শিল্পী বেনারসের ছন্নুলাল মিশ্র, ধ্রুপদী কণ্ঠসংগীত শিল্পী গোয়ালিয়র ঘরানার মালিনী রাজুরকর, কর্ণাটকি ক্ল্যারিওনেটবাদক এ কে সি নটরাজন, দক্ষিণী ও হিন্দুস্থানী সংগীতকার টি ভি গোপালকৃষ্ণণ, লোকসংগীতশিল্পী তীজন বাঈ এবং মিউজিকোলজিস্ট ভারত গুপ্ত। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে শিল্পীদের হাতে এই সম্মান তুলে দেবেন স্বয়ং রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু। যাঁরা ফেলো নির্বাচিত হয়েছেন তাঁরা প্রত্যেকে পাবেন স্মারক হিসেবে একটি তাম্রপত্র, একটি অঙ্গবস্ত্র এবং সাম্মানিক ৩ লক্ষ টাকা!
কিন্তু বাঙালি যেন বুঝতে পারছে না, এই 'ফেলোশিপে'র সম্মানটা ঠিক কতটা মর্যাদাপূর্ণ। এই সম্মানের বিষয়ে তাদের হয়তো তত স্পষ্ট ধারণাও নেই। তারা 'সংগীত নাটক একাডেমি' পুরস্কার পাওয়াটা বোঝে। যে-সম্মান স্বপন চৌধুরী সেই ১৯৯৬ সালেই পেয়েছেন। তার ছাব্বিশ বছর তিনি পেলেন এই 'সংগীত নাটক একাডেমি ফেলোশিপ'।
আরও পড়ুন: Tabla Maestro Pt Swapan Chaudhuri: বিরল সম্মানে ভূষিত তবলাবাদক পণ্ডিত স্বপন চৌধুরী!
জেনে রাখা জরুরি, স্বপন চৌধুরীর আগে মাত্র ১৬ জন বাঙালি এই বিরল সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৬২ সাল থেকে এই ফেলোশিপ প্রদান শুরু হয়। প্রথম বছর পেয়েছিলেন বিষ্ণুপুর ঘরানার সংগীতশিল্পী গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর পর থেকে যেসব বাঙালি এই সম্মানে সম্মানিত হয়েছেন তার তালিকা দেখলে চমকে উঠতে হয়। তালিকায় আছেন-- উদয় শঙ্কর, স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ, ডি এল রায়ের পুত্র দিলীপকুমার রায়, শম্ভু মিত্র, তারাপদ চক্রবর্তী, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, রবিশঙ্কর, সত্যজিৎ রায়, উৎপল দত্তের মতো বিরল প্রতিভাবান ক্ষণজন্মা শিল্পী, স্রষ্টা, কৃতি প্রতিভাধর সব মানুষজন। শেষবারের মতো বাঙালির কপালে এই পুরস্কার জুটেছিল ১৪ বছর আগে, খালেদ চৌধুরীর সৌজন্যে। আর ২০২২/২৩-য়ে এই ব্র্যাকেটের মধ্যে ঢুকে পড়লেন স্বপন চৌধুরীও।
এখনও পর্যন্ত সারা ভারতে মোট ১২৩ জন এই ফেলোশিপ পেয়েছেন। এর মধ্যে সংগীতজগতের ৮৯ জন আছেন! তাঁদেরই একজন স্বপন চৌধুরী! একাডেমি এই ফেলোশিপ দিয়ে ফেলোশিপ-প্রাপককে 'রত্ন সদস্য' বলে সম্বোধন করে। অর্থাৎ, নিজের কাজের ক্ষেত্রে স্বপন চৌধুরীর যে অ্যাচিভমেন্ট তার জেরে তিনি এবার থেকে দেশের 'রত্ন' হিসেবে বিবেচিত হলেন ( সংগীতমহলের একাংশ বলছেন, এর অর্থ এই নয় যে, স্বপন চৌধুরী এতদিন অসামান্য ছিলেন না! তিনি রত্নই ছিলেন, কিন্তু স্বীকৃতি এল দেরিতে)। অর্থাৎ, তিনি এখন থেকে ভারতের কলারত্ন, সংগীতরত্ন, বাদ্যরত্ন হিসেবে বিবেচিত!
বঙ্গদেশকে তাই রত্নগর্ভা বলাই যায়। আমাদের 'তবলারত্ন' স্বপন চৌধুরী বাংলা মায়ের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে প্রতিনিধিত্বমূলক মুখ তো ক্রমশই কমছে বাঙালির। সারা দেশে কজন বাঙালিকে একডাকে চেনেন ভারতবাসী? নাম খুঁজতে গেলে এখনও সেই অমর্ত্য সেন বা সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের নামই হয়তো উঠে আসবে। দীর্ঘদিনের এই প্রতিভা-খরার মধ্যে, সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে সাফল্যখরার মধ্যে, সব প্রদেশের মানুষের কাছেই গ্রহণযোগ্য হয়ে না-উঠতে-পারার মধ্যে স্বপন চৌধুরী মূর্তিমান ব্যতিক্রম, তিনি ভারতের ধ্রপদী সংগীতবাদ্যের জগতে এক জ্যোতিষ্ক-সম উজ্জ্বল নাম এখন।
সংগীতমহলের একাংশ স্বপন চৌধুরীর এই সম্মানপ্রাপ্তিতে খুশি ও আনন্দিত হলেও এখনও সাধারণ মানুষের মধ্যে যেন বিষয়টি নিয়ে তত সাড়া পড়ে যায়নি। সংশ্লিষ্টমহলের একাংশের মত, স্বপন চৌধুরী বরাবরই প্রচারবিমুখ, একটু নেপথ্যচারী, ফ্ল্যামবয়্যান্সিকে সযত্নে সরিয়ে রেখে বাজনার নিখাদ আনন্দে ডুবে থাকা এক শিল্পী। তাই হয়তো বাঙালি তাঁর মেজাজের সঙ্গে তত 'রিলেট' করছে না। কিন্তু আর যা-ই হোক, বাঙালির তো হুজুগে বলে একটু 'দুর্নাম' আছে! তা, নিজের সেই দুর্নামের প্রতিই না-হয় একটু সুবিচার করুক এবার বাঙালি! এখন স্বপন চৌধুরীর জন্য হইহই না করলে, উল্লাস না করলে আর কবে করবে তারা? সাতাত্তরটা বসন্ত পার করে ফেলেছেন পণ্ডিত স্বপন চৌধুরী। বাঙালির কি আত্মসম্মান, আত্মমর্যাদা, আত্মশ্লাঘা কম পড়িল? কম পড়িয়াছে তার জাত্যভিমানে? কলকাতা কি তার নিজের ঘরের গৌরবে জেগে উঠবে না?