মহা X (সেলিব্রিটি + সেরিব্রাল) উত্সব বনাম মহান সচিন তেন্ডুলকর
হর দিন “মা” এপিসোডের পর হপ্তান্তে যেমন “মহা-মা” হয়, সফট ড্রিঙ্ক কোম্পানি যেমন নয়া বোতল বাজারে আনার সময়ে “মহা” প্রিফিক্স জোড়ে, বারোয়ারি দুর্গাপুজো হঠাত্ই কনটেস্টে নামবার আগে “মহা”পূজা নামে এফিডেভিট করায়, তেমনি এ বছরের কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সবেও লক্ষ্মণরেখা মুছে দিয়ে মহোত্সব হল।
হর দিন “মা” এপিসোডের পর হপ্তান্তে যেমন “মহা-মা” হয়, সফট ড্রিঙ্ক কোম্পানি যেমন নয়া বোতল বাজারে আনার সময়ে “মহা” প্রিফিক্স জোড়ে, বারোয়ারি দুর্গাপুজো হঠাত্ই কনটেস্টে নামবার আগে “মহা”পূজা নামে এফিডেভিট করায়, তেমনি এ বছরের কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সবেও লক্ষ্মণরেখা মুছে দিয়ে মহোত্সব হল। গত দুবারে যে প্রস্তুতি চলছিল, সেটারই চমত্কার একটা নিটোল গোল চেহারা পেল ১৯ তম কলকাতা চলচ্চিত্র উত্সব।
ফুলকলি বরাবরের লেট। এক হপ্তা কেটে যাওয়ার পরে একটি আর্টিকেল টাইপ করতে বসেছে। একেবারে ডাই ডাউন করার আগে উত্সবের স্ফূর্তি শেষবারের মতো একবার ডুব দেওয়া আর কী। বিশেষত, উত্সবের আয়োজন যেখানে ছিল সুবিশাল, বিস্তৃতি ছিল যোজন যোজন দূর। কর্পোরেটাইজেশনের চূড়ান্ত নমুনা যেখানে বিদ্যমান।
আমরা জার্নালিস্টরা আজকাল আর কোনও কিছুই খুলি না। সব কভার করি। আমার কাঁধেই দায়িত্ব পড়ল কভার করি। মিথ্যে বলব না, এ বছরের মোচ্ছব ছিল এক কথায়, চাঁদের হাট, তারার মেলা, সূর্যের মতো উজ্জ্বল। উত্সব নয়, ফি-দিন ইতিহাস গড়ার পরিকল্পনা নিয়েই শুরু হয়েছিল এই চলচ্চিত্র উত্সব। আর অবশ্যই স্পেশাল অ্যাটেনশন দেওয়া হয়েছিল যাতে মিডিয়ার জন্য একাধিক হেডিং/ব্রেকিং থাকে। উদ্বোধনের দিন থেকেই! একই মঞ্চে মুম্বই-চেন্নাই সুপারস্টারদের সুপারহিট মুকাবিলা। সস্ত্রীক অমিতাভ বচ্চন, শাহরুখ খান, কমল হাসান। এক মঞ্চে বম্বে-বাংলা মধুর মিলন। অমিতাভ-শাহরুখ-মিঠুন-প্রসেনজিত্। এক মঞ্চে বাংলা-তামিল-বলিউড! বিস্ময় আর আহ্লাদের শেষ নেই। এমন কে কবে দেখেছে? মারাঠা-দ্রাবিড়-বঙ্গ, গঙ্গা-যমুনা-জলধিতরঙ্গ। এ ছবি উত্সব প্রাণঢালা আবেগের। যুক্তি আর দুর্বোধ্যতাকে দুর হটিয়ে, সবার জন্য সমান ভাগ। প্রচুর দর্শক আসুক দেখুক, জীবনের প্রথম বা শেষ ইচ্ছেপূরণ করুক, এই ছিল উদ্দেশ্য। সে কী দৃশ্য স্টেজে! শরীর মন জুড়িয়ে যায়। উদ্বোধনীতেই বিরাট তারকা বুফে পেয়ে গেলেন দর্শক। যার যাকে পছন্দ তার জন্যেই গলা ফাটাতে পারলেন। এ দিন দর্শকেরই। মেলা তারকারা তখন একটু-আধটু চোরা কনটেস্টের ফাঁদে পড়েছেন। বাংলার দাদা বনাম বম্বের জেঠু। মুম্বই মেগাস্টার বনাম বাংলার মেগাস্টার। তামিল ইন্ডাস্ট্রির মাথার সঙ্গে মুম্বই ইন্ডাস্ট্রির মাথার হেড-অন কলিশন। সাবিত্রী-সুপ্রিয়া-সন্ধ্যা রায়-সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। দেব-জিত্-আবির-পরমব্রত-শ্রাবন্তী-কোয়েল-সায়ন্তিকা। পেছনের সারিতে শতাব্দি আর তাপস পালও কোন ফাঁকে এসে বসলেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, যিনি অবশ্যই এই উত্সবের লাইফ ব্লাড, উদারমনে সবান্ধবে নিমন্ত্রণ জ্ঞাপন করলেন।
উদ্বোধনীটা মানে মানে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন মুম্বইয়ের ভদ্রলোক। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে ম্যাচটা তিনদিনেই পেড়ে ফেলল ধোনির টিম। কাজেই দশ তারিখে ইডেন গার্ডেনে খেলা শেষ আর নেতাজি ইনডোরে চলচ্চিত্র উত্সবের শুরু, এই দুয়ে মিলে যে প্যান্ডেমোনিয়াম আশা করেছিল কলকাতা পুলিশ, তার একটুকুও হল না। এদিকে মিডিয়াও মনের সুখে স্টেডিয়ামের বাইরে থেকে আউটপুট নিয়ে দিব্যি পটের বিবিটি হয়ে বসে রইল। লাইভ টেলিকাস্ট। চাপ কিসের? সচিন নিয়ে এই রোববারের বাজারে আর মাথা ঘামাতে হল না। আবার চোদ্দ তারিখ মুম্বই তে শুরু ২০০তম ক্রিকেট ম্যাচ। তখন দেখা যাবে!
ফেস্টিভ্যালের খোলনলচে বদলেছে। অবিশ্রাম আঁতলামি নিপাত গিয়েছে। যাঁরা বছরভর দেরিদা-লাকা-ফুকোয় সুখটান দেন, উত্সবের আঙিনায় এসে যথেষ্ট পরিমাণে জার্মান, রাশিয়ান ও শ্লোভাকিয়ান খোরাক না থাকলে নাক সিঁটকে ফিরে যান, তাঁদের জন্য বিশেষ করে কান দেওয়া হয়েছে। কান ফেস্টিভ্যালের কম্পিটিশন সেকশনে নির্বাচিত ছটি ছবি এ উত্সব তাদেরও ব্রেকফাস্ট থেকে ডিনার জোগানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। যাঁরা মোটেই সিনেমা বোঝেন না, দিনরাত কেবলই “ভাল বই” দেখেন আর “পুরনো বইগুলো ভাল ছিল” বলে আক্ষেপ করেন, তাঁদের জন্য ছিল একেবারে বাছাই করা “গল্পবই” সমগ্র। একশো বছরের হিন্দি ছবির ভান্ডার থেকে সিলেকটিভ ছবির সমাহার, হীরালাল সেন মঞ্চে। সেলুলয়েডের সঙ্গে পুরনো সম্পর্ক ঝালিয়ে নেওয়ার জন্য ছিল শতবর্ষের স্মরণ। বার্ট ল্যান্সেস্টর, ভিভিয়েন লেই, বলরাজ সাহনি। ছিল বিলি ওয়াইল্ডারের একগুচ্ছ ছবি, যাঁরা বরাবরের জন্য সিনেমাকে ভালবাসেন তাঁদের জন্য। ডাউনলোডিং-এর খোলা বাজারেও যাঁরা হলমুখী হন বিদেশি ছবির রসাস্বাদন করবেন বলে, তাঁদের জন্যেও ভরপেট আয়োজন কিছু কম ছিল না। তেষট্টিটি দেশ থেকে আনা সম্পদ। নয় নয় করে বেশ বেশিই। যাঁরা হলের এসির শীতলতায় একটু হাই তুলে জিরোতে চান তাঁদের জন্য ছিল হোমেজ সেকশন। আর যাঁরা একেবারে নাক ডাকিয়ে ঘুমোতে চান তাঁদের জন্য তো ছিলই সাউথইস্ট এশিয়ার ছবি। এত স্লো যে মাঝে মাঝে গুলিয়ে যাবে সিনেমা চলছে নাকি স্লাইডশো... যাকগে, ভিন্নমত আর বিতর্ক দুটোই সলিসিটেড।
কিন্তু অত আয়োজনেও বাধ সাধলেন যিনি, তিনি এই উত্সব থেকে বড়ই দূরের মানুষ। জীবনের কৈশোর থেকে মধ্যবয়স অবধি ক্রিকেটের ক্রিজেই দিয়ে এসেছেন যিনি। ক্রিকেটবিশ্ব যাঁকে প্রাতঃস্মরণ করেন আর এবার থেকে নিয়মিত করবেন। সেই সচিন তেন্ডুলকর খেললেন জীবনের শেষ টেস্ট। ২০০ তম। যে যুগ থেকে তিনি শুরু করলেন সেখান থেকেও এত দূর দৃষ্টি
অতএব এত আয়োজন করেও, ফোকাস শিফট হয়ে গেল। আড়ালে আবডালে অনেক নিন্দুকই মুচকি হাসলেন। টিভি চ্যানেল থেকে খবরকাগজ থেকে ইন্টারনেট। সর্বত্র সচিন ধ্যান সচিন জ্ঞান। কত যে অপার আশ্চর্যময় এযাবত্ অনাবিস্কৃত সচিনের ইনফো বেরিয়ে এল! ফি-বছর যেমন কেজি দরে অপ্রকাশিত রবীন্দ্রনাথ শরত্চন্দ্র সত্যজিত্ বের হয় পুজোবার্ষিকীতে, সেই স্পিডেই সচিন নিয়ে কত অপ্রকাশিত তথ্য বেসরিয়ে এল, কেউ যে কেন এতদিন তার নাগাল পায়নি, সেটাই অবাক ব্যাপার। ফলত, এত বড় মোচ্ছব কাভারেজের জন্য ওবি ভ্যান দূর অস্ত্, ব্যাগপ্যাক পাওয়াই দুষ্কর হয়ে দাঁড়াল। অলিগলি ফুটপাথে সব ক্যামেরা তখন খুঁজছে সচিনপ্রেমে অন্ধ সব উন্মাদদের। সচিনের পূর্ব ও পরজন্ম নিয়ে জ্যোতিষী কী বললেন, সেই নিয়েও চলছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এদিকে ফেস্টিভ্যালে নিত্যিদিন খ্যাতনামা নামজাদা ইন্ডাস্ট্রি পিপল ফিল্ডিং কাটছেন, ক্যামেরার চোখ দেখেও দেখছে না। স্টোরি করলে ধরানোর জায়গা কই..? ব্যাপারটা এমন হয়ে দাঁড়াল যে, পজিটিভ নেগেটিভ কোনও কাভারেজই হয় না। আরও দুঃখের কথা কী বলব, যেদিন শর্মিলা ঠাকুর এলেন উত্সবের আঙিনায়, সেদিন এক্ক্েবারে তাজ্জব কাহিনি। ফোম এল, “অ্যাই ফুলকলি। ফেস্টিভ্যালে কিছু ছেলেপিলে জোগাড় করে রাখ তে সচিন নিয়ে একটা ভক্স পপ দে।“ যা হুকুম... মাত্র একদিন ওবি পেলাম। কানে হেডসেট গুঁজে লাইভে দাঁড়িয়েছি কী দাঁড়াইনি, অ্যাঙ্করের মিষ্টি গলা,” মাস্টার ব্লাস্টারকে ঘিরে উত্তেজনার সীমা নেই। সচিন জ্বরে ভুগছে টলিউড, বলিউড হলিউড। আমাদের সঙ্গে এই মুহূর্তে আছেন ফুলকলি। কলকাতা চলচ্চিত্র উত্সব প্রাঙ্গণ নন্দন থেকে...ফুলকলি, ওখানে কেমন দেখতে পাচ্ছ? সচিনের এই বিদায়ী ম্যাচ নিয়ে কী বলছেন সবাই?” অগত্যা...
শেষ পাতে রাজভোগ, রসমালাই। এক মঞ্চে এত রূপ। বিপাশা, সুস্মিতা, রানি, মৌসুমী, কোয়েল। একেবারে আস্ত ফ্যামিলি অ্যালবাম। মা-বাবারা সবাই স্টেজে। একে অপরকে আলিঙ্গন। অত করেও পানসে হয়ে গেল চোখের নিমেষে। লাইভ টেলিকাস্ট পর্যন্ত করা গেল না গো! সচিন যে সেদিনই মুম্বইয়ে সি-অফ প্রেস কনফারেন্সটা ডেকে দিলেন। চারটে থেকে শুরু হয়ে গেল। আমরা সব কাভারেজের বদলে চুপচাপ দর্শকের সিটে বসে সুন্দরীদের মেলা আর পুরস্কার পাওয়া দেখলাম। শেষ হল অপূর্ব একটি লেজার শো দিয়ে। হলে কী হবে! সচিনের মহাপ্রস্থান নিয়ে চ্যানেলে চ্যানেলে যে সেদিনই শোকপালন ও বিতরণ শুরু হয়ে গিয়েছে।
মোদ্দা কথা দাদা, উত্সব কেঁদে গেল নীরবে নিভৃতে। এত করলাম, তবু মন পেলাম না। মন, তন, অশ্রুবারিজল, সব সেই নিয়ে গেল সচিনে।
এই উত্সবের সর্বশ্রেষ্ঠ সারপ্রাইজের কথা না বললে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। বহু বহু বাঙালি মহিলাদের জন্য। আজ কেউ আজ এক সন্তানের মা হয়েছেন, কেউ হায়ার স্টাডিজ-এর জন্য বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন, কেউ বা হয়েছেন উকিল-ডাক্তার-ডিজাইনার...তাঁরা প্রত্যেকে কৈশোরে পা দেওয়ার সময়ে যাঁকে একমাত্র স্বামী হিসেবে বরণ করে নিয়েছিলেন। সবাই ছিলেন অরভিন্দ অ্যাডমিরেশন অ্যাসোশিয়েশনের মেম্বার। সেই তিনি হঠাত্ হাজির উত্সব প্রাঙ্গণে। অরভিন্দ স্বামী। রোজা, বম্বে, সপনে। তেরো বছর বাদে আবার সিনেমাজগতে প্রত্যাবর্তন। মণিরত্নমের কদল ছবির মাধ্যমে। এখন তিনি কোটিপতি বিজনেসম্যান। নিজস্ব সফটওয়্যার রফতানি কোম্পানি। কী যে বলব, পাগল হতে শুধু বাকি ছিলাম। সেদিন আমার কাছে কোনও ক্যামেরা ছিল না!!
পরের বছর কুড়ি পার। পাল্টে যাবে কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের লোগো। অনেক স্মৃতিই রিপিট হবে। শুধু শেষবেলায় যাঁর কথা উল্লেখ করলাম, তিনি এমনভাবে মৃত মাধুরীর কণা উসকে দিয়ে গেলেন, এ জন্মে ভোলার নয়।
ফুলকলি