বৃত্ত

বৃত্তটি রচনা করি নিজে। এ সেই বৃত্ত যা আক্ষরিক অর্থেই আমাদের অন্তরমহল। আমি ও আমার পারিপার্শ্বিক। একা এবং কয়েকজন। এই কয়েকজন 'যাকে আমি গ্রহণ করেছি দুহাতের কম্পিত নৌকায়'। এই বৃত্ত আমাদের স্বরচিত। আমার নিজস্ব। যেখানে আমি অকপট, আমি অবিরল। ছোট্ট সে গণ্ডি। মাত্র কয়েকজন সেই বৃত্তের অন্তর্গত। সপ্তদশ শতকের ইংরেজ কবি জন ডান এইরকম এক বৃত্তভাবনার কথা বলে গিয়েছিলেন। আমরা যেভাবে গণিতে বৃত্ত আঁকতে কম্পাস ব্যবহার করি, তিনিও সেইভাবে বৃত্ত রচনা করেছিলেন।

Updated By: Nov 10, 2012, 09:51 PM IST

বৃত্তটি রচনা করি নিজে। এ সেই বৃত্ত যা আক্ষরিক অর্থেই আমাদের অন্তরমহল। আমি ও আমার পারিপার্শ্বিক। একা এবং কয়েকজন। এই কয়েকজন 'যাকে আমি গ্রহণ করেছি দুহাতের কম্পিত নৌকায়'। এই বৃত্ত আমাদের স্বরচিত। আমার নিজস্ব। যেখানে আমি অকপট, আমি অবিরল। ছোট্ট সে গণ্ডি। মাত্র কয়েকজন সেই বৃত্তের অন্তর্গত। সপ্তদশ শতকের ইংরেজ কবি জন ডান এইরকম এক বৃত্তভাবনার কথা বলে গিয়েছিলেন। আমরা যেভাবে গণিতে বৃত্ত আঁকতে কম্পাস ব্যবহার করি, তিনিও সেইভাবে বৃত্ত রচনা করেছিলেন। এইভাবে,

A velediction: forbidding mourning-
If they be two, they are two so
As shift twin compasses are two
Thy sole the fixed, foot, makes no show
To move, but doth, if they other do.

জন ডানের এই বৃত্তটি বাঁধা আছে একটি বিন্দুতে। সে তার বাইরে বেরোতে পারে না। কম্পাস নিয়ন্ত্রণ করে সেই বৃত্ত। ফিরে আসতে হয় তার কাছে- If they be two, they are two so.../ To move, but doth, if they other do.

জন ডান কম্পাসটিকে স্ত্রীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন। দাম্পত্য নিয়ে বলতে গিয়ে জানিয়েছিলেন, আমি ফিরে আসি সেই কেন্দ্রস্থলে। ঠিকই, যেকোনও বৃত্তের একটি কেন্দ্রস্থল অবশ্যই থাকবে। নাহলে সেই বৃত্তটি রচনা হবেই বা কীসের ভিত্তিতে! কিন্তু এই বৃত্তকে কি আরও প্রসারিত করা যায় না? অবশ্যই যায়। তবে সেই বৃত্তের প্রসারণ ঘটাতে লাগে এক বোধ। এর জন্য প্রচুর জ্ঞানার্জনের প্রয়োজন নেই আমাদের। প্রয়োজন প্রসারিত মন। ডাকঘরে যে অমল বলে, আমাকে পণ্ডত হতে বলো না পিসেমাশাই, সেই বালকই তার বৃত্তকে পারিপার্শ্বকের চেয়ে বড়ো করে নিতে পারে। গোরা উপন্যাসে গোরার বৃত্তও একইভাবে প্রসারিত হয়ে ওঠে। অমল এবং গোরা-দুই অসমবয়সীর মধ্যে মিল একটাই। চিন্তার বিস্তার। ভাবনার প্রসার।

এই অন্তহীন পরিধি বিস্তারেও একটি কেন্দ্র থাকে, একটি উৎসস্থল থাকে যেখানে ফিরতে হয় আমাদের। বৃত্তকে প্রসারণ করতে যেমন ফিরতে হয় তার কেন্দ্রে। ওই ভরকেন্দ্রটি রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে 'আনন্দ'। রবীন্দ্রনাথের 'আনন্দ'-ই বৃহত্তর এক বৃত্ত রচনা করেছিল। অথচ আমদের কেন্দ্রস্থল সবসময়ই 'আমি'। আমি বলতে পারি না, ' এ আমির আবরণ সহজে স্খলিত হয়ে যাক' বা ' মোর আমি ডুবে যাক নেমে'। রবীন্দ্রনাথ বলতে পারেন। আমরা বেঁচে থাকি ক্ষুদ্র 'আমি-র' মধ্যে। আমি ওই, আমি সেই- আমি গ্রহণ করিনা 'সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।'

বৃত্ত তখনই বড় হয়ে ওঠে যখন এই ভাবে ভাবতে শেখান কেউ। বিবেকানন্দ মঙ্গল কামনা করেছিলেন। আমার-তোমার নয়- গোটা বিশ্বের। তাই তিনি আন্তর্জাতিক। তাঁর বৃত্ত বিশ্বজনীন।

রবীন্দ্রনাথও তো একইভাবে বিশ্বজনীন। কেননা তিনিও তাঁর আনন্দকে কেন্দ্রস্থল করে বলতে পারেন 'বিশ্বসাথে যোগ যেথায় বিরাজ/ সেইখানে যে যোগ তোমার সাথে আমারও।'

বিশ্বকে এমন নিবিড় করে যিনি ভাবতে পারেন - এমন বৃত্ত রচনা করতে পারেন- আমরা তাঁরই দীক্ষিত হয়ে গ্রহণ করতে পারি- 'অচেনাকে ভয় কী আমার ওরে/ অচেনাকেই চিনে চিনে উঠবে জীবন ভরে...।' এর চেয়ে বড় মন্ত্র ( মন কে যে ত্রাণ করে তাই তো মন্ত্র!) আর কী হতে পারে আমদের এই জীবনে।

সোমশুভ্র মুখার্জি
(অ্যাসাইনমেন্ট কো-অর্ডিনেটর)

Tags:
.