Kazi Nazrul Islam: শেষ ৩৪ বছর বোবা! তবু মাত্র দু'দশকের সৃষ্টিতেই আজও দু'দেশের সুর-সেতু তিনিই...

Kazi Nazrul Islam Birth Anniversary: 'আর-সব কিছু ভাগ হয়ে গেছে, ভাগ হয়নি কো নজরুল'! কে বা কী ভাগ হতে দিচ্ছে না নজরুলকে? নজরুলকে ভাগ হতে দেয়নি তাঁর গান। আজও এপার বাংলা ওপার বাংলা সমান আবেগে সমান প্রণোদনায় কণ্ঠে তুলে নেয় তাঁর গান। গানে-গানেই বন্ধন ঘুচে গিয়েছে তাঁর।

Updated By: May 25, 2023, 04:40 PM IST
Kazi Nazrul Islam: শেষ ৩৪ বছর বোবা! তবু মাত্র দু'দশকের সৃষ্টিতেই আজও দু'দেশের সুর-সেতু তিনিই...

সৌমিত্র সেন

বহুব্যবহৃত, তবু এ-লেখা শুরু করতে গিয়ে ধরতাই হিসেবে আর একবার অন্নদাশঙ্কর রায়ের লাইনটি মনে করতেই হচ্ছে। অন্নদাশঙ্কর লিখেছিলেন--'আর-সব কিছু ভাগ হয়ে গেছে/ভাগ হয়নিকো নজরুল!' অসাধারণ পংক্তি। নজরুলের অসাধারণ কাব্যিক মূল্যায়ন। কিন্তু বাস্তবেও কি তাই? ফুলের জলসায় কী সুরের তান কবি সাধলেন যে, ভাগ হতে-হতেও হতে হল না তাঁকে? 

তা হলে কিছু খণ্ড ছবি দেখে নেওয়া যাক। নতুন প্রজন্মের ব্যান্ডশিল্পীরা নজরুলের গানের দিকে ঝুঁকছেন। নজরুলগান ঝড় তুলছে নতুন দিনের সংগীতশিল্পীর গিটারে, কি-বোর্ডে, কণ্ঠেও। নজরুলের 'বিদ্রোহী' কবিতা গান হয়ে মুখে-মুখে ফিরছে আজও। তরুণদের মধ্যে ক্রমশ দারুণ জনপ্রিয় হচ্ছে ব্যান্ডগীত 'দুর্গম গিরি, কান্তার মরু'। তথ্য বলছে, নজরুলের একটি গান গত ১৪ মাসে ২ কোটি ১৫ লাখ ৯২ হাজার বারেরও বেশিবার 'ভিউ' হয়েছে। মাসখানেক আগে নব-আঙ্গিকে 'মুক্তি পাওয়া' নজরুলের আর একটি গান ৭৭ লাখ ৫২ হাজার বারেরও বেশি 'ভিউ' হয়েছে! এই সমস্ত তথ্যই অবশ্য বাংলাদেশের। একেবারে শেষে যেদুটি গানের হিসেব দেওয়া হল, সেগুলি হল যথাক্রমে 'বুলবুলি' ও 'দাঁড়ালে দুয়ারে'। 

বাংলাদেশ বাংলা ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং বাংলা গান নিয়েও হয়তো এ-বঙ্গের থেকে একটু বেশি প্রাণিত। তাছাড়া নজরুল সে-দেশের জাতীয় কবিও। কিন্তু সেটা কোনও প্রশ্ন নয়। নজরুলের গানের মধ্যে সেই শাশ্বত মাধুর্য, সেই চিরকালীনতা আছে বলেই-না আজও নতুন প্রজন্ম তাঁর গানের কাছে ফিরছেন!

আরও পড়ুন: Rabindranath Tagore: কবিজীবনের প্রথম ও শেষ রেলযাত্রা একই রুটে! আজও শ্রদ্ধাবনত রেল...

এপার-বাংলাতেও ছবিটা এর কাছাকাছিই। রবীন্দ্রগানের তুলনায় পরিমাণে অনেক কম হলেও আজও এখানকার শিল্পীরা নজরুলের কাছে ফেরেন। নজরুলের গানের কাছে ফেরেন। নজরুলের নতুন অ্যালবাম তৈরি করেন। নতুন আঙ্গিকে, নতুন সংগীত-আয়োজনে নজরুলগীতিকে নতুন করে আবিষ্কার করতে চান। 

ফলে বলাই যায়, অন্নদাশঙ্করের বহু-চেনা, বহু-শ্রুত, বহু-উল্লেখিত মন্তব্যটি আজও পুরনো হয়নি। ধর্ম-বর্ণ কিংবা জাতিভেদ দিয়ে নজরুলকে সত্যিই ভাগ করা যায়নি। এর কারণ হয়তো তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও মানবতাবোধ। গানে-কাব্যে সদাসর্বদা ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধ্বে উঠে থাকা। এবং সুরে সুরে এক সদা-প্লাবিত প্রেমের উৎসরাণ! কী বাংলাদেশ কী ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গ-- দু তরফের কাছেই তাই হয়তো নজরুল এখনও সমান বরণীয়। 

নজরুলকে ঘিরে এই যে-সেতুটা তৈরি হয়েছে দুই বাংলায়, সেটার অনুঘটক কিন্তু তাঁর গানই। নজরুলের গানের সুরই নীরবে গেঁথে দিচ্ছে এপার-ওপারকে। সংগীতের নজরুল সর্বার্থেই এক বিস্ময়। প্রথাগত কোনও সংগীতশিক্ষা তাঁর ছিল না। বাল্যেই পিতৃহারা। এরপর কখনও লেটোর দলে গান গাওয়া, পাউরুটি কারখানায় কাজ করা, কখনও রেলের গার্ড সাহেবের ফাইফরমাস খাটা নজরুলের জীবন আর পাঁচজন কবিশিল্পীর ছোটবেলার মতো একেবারেই কাটেনি। নিজেকে তৈরি করে নেওয়ার কোনও সুযোগ কোনওদিন তাঁর সামনে আসেনি।

আরও পড়ুন: Remembering Ranajit Guha: তিনি মানুষের মধ্যে ইতিহাস খোঁজেন, ইতিহাসের মধ্যে মানুষ...

কিন্তু সুর ছিল তাঁর রক্তে। লেটোর দলে ঘুরে বেড়ানো বাউন্ডুলে নজরুল বাংলার মাটি থেকেই তো শুধু নয়, পারস্য থেকেও চয়ন করেছিলেন তাঁর গানের সৃজনপ্রেরণা। কতরকম সংগীত-সংস্কৃতি যে তিনি আত্মস্থ করেছিলেন! তাঁর সাংগীতিক প্রতিভার পটভূমি কীভাবে তৈরি হয়েছিল তার কোনও ইতিহাস লিপিবদ্ধ নেই। মুজফফর আহমেদ তাঁর স্মৃতিকথায় জানিয়েছেন, কলকাতায় আসার পর রবীন্দ্রসংগীতই তাঁর (নজরুলের) পরিবেশনার শীর্ষস্থানে থাকত। চুরুলিয়ার বাউন্ডুলে কৈশোরজীবনে কিংবা করাচির সেনানিবাসে রবীন্দ্রনাথের গান কী করে আয়ত্ত করেছিলেন নজরুল, সে এক বিস্ময়! 

কিন্তু বাল্যকৈশোরে শুধু লেটোর দলের গানই নয়, বা শুধু রবীন্দ্রগানই তো নয়, নজরুল একে-একে আত্মস্থ করেছিলেন রাগসংগীত, গজল, কবিগান, ঢপ, কীর্তন, আখড়াই, ভাদু, মনসার গান, কাওয়ালি, ঝুমুর, পাঁচালির মতো লোক-আঙ্গিকও। যা পরবর্তী সময়ে তাঁর গানকে ভিতরে-ভিতরে নির্মাণ করে তুলেছিল। এতটাই যে, শুরু থেকেই একক ভাবে নজরুলের সাংগীতিক প্রতিভার উপর ভর করেই গ্রামফোন কোম্পানি তাদের বাংলা গানের বিপণন-ব্যবসাকে পোক্ত করে তুলতে পারল। 

অথচ, কী সামান্য সময়ের মধ্যেই না-ঘটেছিল এই অসামান্য সৃষ্টি-বিস্ফোরণ! নজরুলের জন্ম ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ (১৮৯৯ সালের ২৪ মে)। বেঁচেছিলেন বটে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত। কিন্তু কবির পক্ষে সে তো না-মরে বেঁচে থাকা। কবি কি কখনও ফুলের জলসায় নীরব থাকতে পারেন? কিন্তু ঘটনাচক্রে তো তা-ই থাকতে হল তাঁকে! কেননা ১৯৪২ সালের অগস্ট থেকেই তিনি বাকশক্তি হারিয়ে ফেললেন! তখন তাঁর বয়স মাত্র তেতাল্লিশ! এরপর বেঁচেছিলেন আরও ৩৪টি বছর! ১৯৭৬ সালের ২৯ অগস্ট দেহাবসান। তাহলে তাঁর সচেতন সৃষ্টির সময়কাল দেখা যাচ্ছে মাত্রই ২১ বছর! ১৯২০ থেকে ১৯৪১! সামগ্রিক সেই সৃষ্টির ক্যানভাসে তো রয়েছে কবিতা-উপন্যাস-গল্প-প্রবন্ধ রচনা, গ্রামোফোন কোম্পানির পর্ব, ছবিতে অভিনয় ও সংগীত পরিচালনাও! আর সেসবের সঙ্গে-সঙ্গেই গান! কিন্তু দুর্মর প্রতিভা তো বরাবরই এমন দুর্বোধ্য রহস্যেই ভরা! সেই রহস্যের খোঁজেই কি আজও দুই বাংলার মানুষ ফিরছে তাঁর গানের রাজ্যে? 

(Zee 24 Ghanta App দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App) 

.