Narayan Debnath: নারায়ণ দেবনাথের মৃত্যুর সঙ্গেই কি মৃত্যু হল বাঙালির প্রথম সুপারহিরোর?
জন্মলগ্নের পরে 'সন্দেশ'-এর ফেলুদা আর 'শুকতারা'র বাঁটুল ভিন্ন আঙ্গিকে অনেক পথ পেরিয়েছে।
সৌমিত্র সেন
১৯৬৫ সাল! নানা কারণে হয়তো স্মরণীয়, তবে বাংলা সাহিত্যের প্রেক্ষিতে তা বিশেষ ভাবে মনে রাখার মতোই এক সালতামামি।
কেন?
এই জন্যই যে, বিষয়টি এক অপূর্ব কাকতালীয়ের জন্ম দিয়েছে।
কাকতালীয়?
তা নয় তো কী? এই ১৯৬৫ সালেই দুই শিল্পীর হাতে দু'ভাবে দুই আঙ্গিকে জন্ম নিল সম্পূর্ণ ভিন্ন জাতের দুটি চরিত্র। দুটি চরিত্রই বাঙালিকে, বা বলা ভালো বাঙালি কিশোরকিশোরীকে সেই প্রথম, ধার করা ভাবনায় নির্মিত নয়, সম্পূর্ণ খাঁটি অর্থে যাকে বলে 'ইনডিজেনাস সুপারহিরো'র সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল।
কোন দুটি চরিত্র?
একটি হল সত্য়জিৎ রায়ের সৃষ্ট চরিত্র রজনী সেন রোডের বাসিন্দা গোয়েন্দা প্রদোষ মিত্র তথা 'ফেলুদা'। অন্যটি, নারায়ণ দেবনাথের রেখা ও লেখায় শক্তি ও সারল্যের মিশেলে তৈরি মজাদার 'বাঁটুল দ্য় গ্রেট'! বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস জানাচ্ছে, দু'টিই ঘটনাচক্রে ১৯৬৫ সালেই প্রথম ছাপাখানার চৌকাঠ পেরোয়! কাকতালীয় নয়?
এরপর তো 'সন্দেশ' পত্রিকায় ফেলুদার বর্ণিল ফেনিল জয়যাত্রা; আর ওদিকে 'শুকতারা'য় প্রচ্ছদ-কাম-মলাট ওল্টালেই ব্যাক-টু-ব্যাক পেজে স্বরাট দ্য গ্রেট বাঁটুল ও তার বাহিনী! সেই সময়ে বাড়িতে 'শুকতারা' এলে ছেলেমেয়েরা সাততাড়াতাড়ি প্রথম পাতা উল্টে বাঁটুল এবং আরও পাতা উল্টে গিয়ে পত্রিকার ভিতরের দিকে স্প্রেডে হাঁদা-ভোঁদার পাতা দুটি পড়ে ফেলত এক নিঃশ্বাসে! আর এই ভাবেই জন্মলগ্নের পরে সন্দেশে'র ফেলুদা আর 'শুকতারা'র বাঁটুল ভিন্ন আঙ্গিকে অনেক পথ পেরিয়েছে। বাংলাসাহিত্যের শিশুকিশোর সাহিত্যের গঙ্গায় এর পর অনেক রকম উজানভাটির স্রোতই বয়ে গিয়েছে। সত্যজিতের মতো এক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্রনির্মাতার সঙ্গে যা কিছু সংযুক্ত -সম্পর্কিত থেকেছে সে সবই অনেক অনেক গৌরব-খ্যাতি-আলো অর্জন করেছে; ফেলুদা ক্রমে এক বহুচর্চিত, বহুপূজিত অমিত শক্তিধর সুপার ক্যারেক্টারের মহিমা অর্জন করেছে। দিনে দিনে তার কলাবৃদ্ধি ঘটেছে। বইয়ের নীরব পাতা থেকে উঠে এসে তা সিনেমার বাঙ্ময় পরদায় আত্মপ্রকাশ করে আরও-আরও গ্ল্যামার ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। একটা প্রজন্মের পরে বাঙালি কিশোরকিশোরীর কাছে ফেলুদাই এক ও একমাত্র 'সুপারহিরো' হয়ে থেকে গিয়েছে। পুস্তক প্রকাশনা ও ফিল্ম রিলিজের যৌথ-প্রণোদনায় ফেলুদা ক্রমে বাঙালির মননে ও সংস্কৃতিতে এক অনপনেয় মহিমা ও মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, স্রষ্টার মৃত্যুর পরেও ফেলুদার অবারণ চলা পরোক্ষে প্রায় অব্যাহতই থেকেছে। কেননা, হয় সত্য়জিৎ-পুত্র সন্দীপ রায় না-হলে অন্য কারও হাত ধরে ছোট ও বড় পর্দায় মোটামুটি নিয়মিত বিরতিতে ফেলুদার বিনির্মাণ ঘটেছে। জনস্মৃতি থেকে ফেলুদা সরে যাওয়ার অবকাশ পায়নি সেভাবে। বলা ভালো, সত্যজিতের পরে ফেলুদার মতো এক অনন্য সুপারহিরোকে বাঁচিয়ে রাখার মতো জরুরি কাজটি করেছেন সন্দীপ-সহ পরের প্রজন্মের ছবি-নির্মাতারা। অর্থাৎ, ফেলুদার ব্যাটন সত্যজিতের হাত থেকে অন্যতর হাতে স্থানান্তরিত হয়েছে মসৃণ ভাবে। ভালো কথা।
কিন্তু 'বাঁটুল দ্য গ্রেট'? কে লইবে তার কার্য?
নারায়ণ দেবনাথ বহুদিন ধরেই অসুস্থ। ফলে, যে ভাবে জীবনের প্রথম পর্বে তিনি দুরন্ত সৃষ্টিশীলতায় ও উড়ন্ত গতিময়তায় প্রায় দুহাতে, একরকম সব্যসাচীর মতোই বাঁটুল চরিত্রের (সঙ্গে হাঁদা-ভোঁদা, নন্টে-ফন্টে, বাহাদুর বেড়াল, ডানপিটে খাঁদু আর তার কেমিক্যাল দাদু ইত্যাদি ইত্যাদি) নানা কাহিনীর নিরন্তর জন্ম দিয়েছিলেন, পরবর্তীতে সেট ঠিক সেই ভাবে সম্ভব হয়নি। ফলত, শূন্য়তা একটা তৈরি হচ্ছিলই। আর এখন? স্রষ্টা স্বয়ং নারায়ণ দেবনাথের মৃত্যুর পরে? আর কি নতুন দিনের নতুন সময়ের অগণিত বাঙালি কিশোরকিশোরী পাবে অন্য কারও কাছ থেকে বাঁটুল-ঘরানারই অন্যরকম কোনও এক মনে রাখার মতো কিংবদন্তসম সুপারহিরো? স্বয়ং স্রষ্টার কাজের রিপ্রিন্ট বা রিপাবলিকেশন নয়; বরং খানিকটা বিনির্মাণ-জাতীয় কিছু হতে পারে, হবে? যাতে ফিরে ফিরে পাওয়া যায় নারায়ণ দেবনাথের নারায়ণী সেনাদের অমর ফ্লেভার? নাকি, নারায়ণ দেবনাথের মৃত্যুর সঙ্গেই সঙ্গেই মৃত্যু ঘটে গেল বাঙালির অন্যতম প্রথম এক সুপারহিরোর?
আরও পড়ুন: Narayan Debnath Dies: প্রয়াত 'হাঁদা ভোঁদা'র স্রষ্টা নারায়ণ দেবনাথ