সানিয়া আপনার মারা, গালে এই থাপ্পড়টা চিরকাল মনে রাখব
স্বরূপ দত্ত
সানিয়া মির্জা আপনার অতদূর থেকেও মারা থাপ্পড়টায় গাল এখনও লাল হয়ে রয়েছে। লজ্জায় ফেলে দিলেন বড়। আপনাকে ধন্যবাদ দিয়েই তাই শুরু করছি তাই। ভাগ্যিস থাপ্পড়টা আপনি মারলেন। তাই তো লজ্জায়, ব্যাথায়, বোধোদয়টা হয়েই গেল। বলতে কোনও লজ্জা নেই যে, আপনার মারা থাপ্পড়টা অনেক দূর থেকেও ইচ্ছে করে গায়ে পেতে নিলাম। আপনাকে শুধু ধন্যবাদই বা দেব কেন? একটা স্যালুটও অবশ্যই প্রাপ্য আপনার। আপনার মারা এক থাপ্পড়েই তো দিব্যি অন্যরকমভাবে ভাবতে শুরু করলাম। কথা দিচ্ছি, এই থাপ্পড় মনে রাখব। আপনার মতো করেই ভাববো চিরকাল। বাকিদেরও প্রভাবিত করার চেষ্টা করব। আপনার দৃষ্টিভঙ্গী ছড়িয়ে দিতে চাইব অন্যদের কাছে।
ভাবছেন, হলটা কী? খুব সংক্ষেপে বলে দিই। আসলে একটি ন্যাশনাল টেলিভিশন চ্যানেলে রাজদীপ সারদেশাইয়ের সামনা-সামনি বসেছিলেন সানিয়া মির্জা। তাঁর সদ্য প্রকাশিত আত্মজীবনী নিয়েই মূলত চলছিল প্রশ্নত্তোর পর্ব। এরই মাঝে সঞ্চালক রাজদীপ সারদেশাই সানিয়াকে প্রশ্ন করে বসেন, 'আপনার বই পড়লাম। কিন্তু কোথাও পেলাম না, খেলা ছাড়ার পর আপনি কী করবেন? থাকবেনই বা কোথায়? সংসারের খবরই বা কী আর অবশ্যই মাতৃত্ব মানে আপনার কী?' আপাতদৃষ্টিতে একেবারে স্বাভাবিক প্রশ্ন। এমন প্রশ্ন তো সামনের মানুষকে করেই থাকেন সাংবাদিক-সঞ্চালকরা। কিন্তু একটু ক্ষেপেই যান সানিয়া। তবে, মাইক ফেলে দিয়ে উঠে চলে আসেননি। নিজের বক্তব্য বরং, আরও দৃঢ়ভাবে পেশ করে এসেছেন অকপট রাজদীপের সামেনও। সানিয়া বলেন, 'আমি এখনও খেলছি। আরও অনেকদিন খেলতে চাই। আমার খুব খারাপ লাগে, সাংবাদিকরা কোনও মহিলা খেলোয়াড়কে দেখলেই আগে প্রশ্ন করেন, বিয়ে কবে করছেন?সংসার কীভাবে চালাবেন? আর মাতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন না করলে তো হবেই না! কিন্তু আমরা অন্যভাবে ভাবি। আমরা চাই এক নম্বর খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে মেলে ধরতে। কেউ এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করে না। আমি যখন ঘরকন্না নিয়েই শুধু থাকব, নিশ্চয়ই আপনার প্রশ্নের উত্তর সবার আগে আপনাকে দিয়ে যাব।'
সানিয়ার এমন উত্তরের সামনে উদ্ভট তর্ক করতে চাননি বুদ্ধিমান রাজদীপ। সঙ্গে সঙ্গে তিনি এমন প্রশ্ন করার জন্য দুঃখপ্রকাশ করে ক্ষমা চেয়ে নেন সানিয়া মির্জার কাছে। সানিয়াও সৌজন্য দেখিয়ে বিষয়টায় সেখানেই ইতি টেনে দেন। এই হল গোটা বিষয়। ঘটনাটা জানার পর থেকেই মনের মধ্যে বেশ কিছু স্মৃতি ভিড় করে এলো। মনে পড়ল, বিভিন্ন সময়ে অনেক মহিলা ক্রীড়বিদের সামনে দাঁড়াতে হয়েছে। এবং, আমার মুখ থেকেও একাধিকবার বেরিয়েছে, একই প্রশ্ন। চোখের সামনে অন্য সাংবাদিকদেরও দিনের পর দিন দেখেছি, এই ধরনের প্রশ্ন করতে। আমাদের কাছে এতদিন এটাই তো ছিল স্বাভাবিক প্রশ্ন। মহিলা ক্রীড়াবিদকে বিয়ে, সংসার, মাতৃত্ব জিজ্ঞাসা করব না তো করব কী? কিন্তু ওই যে, সানিয়া যে স্বাভাবিক কিংবা সাধারণ নন। তাই তিনি সাধারণ প্রশ্নটার উত্তরই দিলেন অসাধারণভাবে।
সত্যিই তো। পুরুষ ক্রীড়াবিদ হলে তো আমরা তাঁকে এত জিজ্ঞাসা করি না যে, বিয়ে, সংসার কিংবা পিতৃত্ব সম্পর্কে বলুন। মহিলা ক্রীড়াবিদ পেলেই তখন ঘরকন্নার কথায় মন ভরে যায়। কখনও ভেবে দেখি না যে, সামনের ওই মহিলা খেলোয়াড় চোখে কী স্বপ্ন নিয়ে ঘুরছেন। তাঁকে বেঁধে ফেলতে চাই সংসারের আর মাতৃত্বের বাঁধনে। আচ্ছে দিন আসছে কিনা জানা নেই। তবে, হাওয়া বদল একটা হচ্ছে। সানিয়া অন্তত এই বদলটা মানসিকতায় এনে দিলেন। কথা দিচ্ছি, সানিয়ার এই উত্তর শোনার পর, আর কখনও মহিলা ক্রীড়াবিদ মানেই বিয়ে, সংসার, মাতৃত্ব নিয়ে তাঁকে ভাবাতে যাব না। সানিয়া আজ যেভাবে ভাবালেন, সেভাবেই আগামিদিনগুলোতে ভাববো। সবশেষে আরও একবার, ধন্যবাদ সানিয়া পুরুষদের এমন থাপ্পড়টা মারার জন্য।
আরও পড়ুন রূপকথার রাজা রোনাল্ডোর গল্প যেভাবে বুড়ো বয়সে নাতিদের কাছে করবেন